গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
একই দিনে আদালতে জোড়া ধাক্কা খেল দুই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি ও সিবিআই। ইডি-র মামলায় প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের জামিনের নির্দেশ হয়েছে সুপ্রিম কোর্টে। আর শিয়ালদহ বিশেষ আদালতে ৯০ দিনের মধ্যে চার্জশিট দিতে না-পারায় আর জি কর হাসপাতালের চিকিৎসক খুন ও ধর্ষণের মামলায় জামিন মঞ্জুর হয়েছে সন্দীপ ঘোষ ও অভিজিৎ মণ্ডলের। এই জোড়া জামিনের জেরে কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসক দলের শীর্ষ স্তরের ‘বোঝাপড়া’র অভিযোগে ফের সরব হল বাম ও কংগ্রেস। তাদের দাবি, এই রাজ্যে একের পর এক মামলায় ন্যায়-বিচারের সঙ্গে ‘উপহাস’ করা হচ্ছে! রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস অবশ্য সিবিআইকেই নিশানা করছে, পাল্টা রাজ্য পুলিশতে কাঠগড়ায় তুলছে কেন্দ্রের শাসক বিজেপি।
এমতাবস্থায় ‘বিচারের নামে প্রহসনে’র প্রতিবাদে ফের পথে নামছে বাম ও কংগ্রেস। ‘সেটিং ছাড়ো, বিচার করো’ স্লোগান সামনে রেখে আজ, শনিবারই কলেজ স্ট্রিটে বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে সিপিএমের ছাত্র সংগঠন এসএফআই। আর জি করের নির্যাতিতা চিকিৎসকের ন্যায়-বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরিতে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের ‘যোগসাজশে’র প্রতিবাদে আজই সিবিআইয়ের আঞ্চলিক দফতর, বিধাননগরের সিজিও কমপ্লেক্সে বিক্ষোভের কর্মসূচি নিয়েছে এসইউসি। সিজিও কমপ্লেক্সে বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে আরও কিছু সংগঠনও। নিজ়াম প্যালেসে বিক্ষোভ করার কথা কংগ্রেসের। পাশাপাশি, রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ে জমায়েতের আহ্বান জানিয়েছে ‘অভয়া মঞ্চ’।
ইডি ও সিবিআইয়ের তদন্তের পরিণাম নিয়ে প্রশ্ন এ রাজ্যে নতুন নয়। সেই প্রশ্নই ফের জোরালো ভাবে সামনে এসেছে প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ, আর জি কর হাসপাতালের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ এবং টালা থানার প্রাক্তন ওসি অভিজিতের জামিনের ঘটনায়। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীর বক্তব্য, ‘‘কেন্দ্রীয় সংস্থা সম্পূর্ণ ব্যর্থ। একের পর এক জামিন হয়ে চলেছে। এটা কি কেবল অপদার্থতা, নাকি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ঢুকে যাচ্ছে বলে এমন হচ্ছে? মুখ্যমন্ত্রীর উচিত, ফুলের স্তবক নিয়ে তদন্তকারীদের কাছে হাজির হওয়া! তারা ওঁর মুখ রক্ষা করেছে। যোগী-রাজ্যে হাথরস-কাণ্ডে তদন্তে ধামাচাপা দিয়ে নরেন্দ্র মোদীকে খুশি করেছিল যারা, সেই সিবিআইয়ের বাহিনীই আর জি করের তদন্তে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে খুশি করছে।’’ প্রসঙ্গত, সুপ্রিম কোর্ট তিন মাস পরে আগামী মার্চে ফের আর জি কর মামলার শুনানি ধার্য করায় সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম আগেই বলেছিলেন, বিচার প্রক্রিয়া লম্বা হলে আন্দোলনকে আরও লম্বা পা ফেলে এগোতে হবে। বিচার ছিনিয়ে আনতে হবে।
কেন্দ্র ও রাজ্যের দুই শাসক দলের ‘অশুভ সন্দি ও লড়াইয়ের নাটকে’র দিকে আঙুল তুলেছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শুভঙ্কর সরকার, মুখপাত্র সৌম্য আইচ রায়ও। তবে প্রদেশ কংগ্রেসের নেতা অমিতাভ চক্রবর্তী একই সঙ্গে মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘কলকাতায় সিবিআইয়ের দফতর নিজ়াম প্যালেসে অভিযান করে আমরাই বলেছিলাম, রাজ্যের অন্যান্য দুর্নীতির তদন্তের মতো এই তদন্তও প্রধানমন্ত্রীর দফতরের অধীন সিবিআই ধামাচাপা দিয়ে দেবে না তো? সিবিআইয়ের বিরুদ্ধে সেই আন্দোলন যাতে না হয়, তার জন্য তদানীন্তন প্রদেশ কংগ্রেসের দলীয় হ্যান্ড্ল থেকে ফতোয়া দেওয়া হয়েছিল! সেই ফতোয়া উড়িয়ে দিয়ে কংগ্রেস কর্মীরা সে দিন নিজ়াম প্যালেস অভিযান করেছিলেন। এখন প্রমাণ হল, আমরাই ঠিক ছিলাম!’’ তাঁর আরও দাবি, ‘‘বাংলার বিজেপি কর্মীরা মার খাবেন কিন্তু ওঁদের দিল্লির নেতারা সেটিং করে নিয়েছেন!’’
কেন্দ্রীয় সংস্থার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়ে বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলেছেন, ‘‘প্রথম থেকেই বলেছিলাম, খুন ও ধর্ষণের মামলায় সিবিআইয়ের কিছু করার নেই। কারণ, এই মামলা পাঁচ দিন রাজ্য পুলিশের হাতে ছিল। যেখানে ঘটনা ঘটেছিল, সেখানে তাণ্ডব নৃত্য চলেছিল! তার পরে সেখান থেকে সিবিআই আর কী পাবে?’’ একই সুরে রাজ্য বিজেপির অন্যতম সাধারণ সম্পাদক লকেট চট্টোপাধ্যায়ও বলেছে, তথ্য-প্রমাণ লোপাট হয়েছে, রাজ্য সরকার কোনও সহযোগিতা করেনি। আর পার্থের মামলায় সুকান্তের কটাক্ষ, ‘‘তৃণমূলে এখন গৃহযুদ্ধ চলছে। ভাইপো-পক্ষ বনাম পিসি-পক্ষ। এর মধ্যে পার্থ চট্টোপাধ্যায় এলে নতুন অক্ষ তৈরি হবে। চুরির টাকার অতিরিক্ত ভাগ হবে। তাই তৃণমূল হতাশ!’’ তবে বিজেপির আইনজীবী-নেতা কৌস্তভ বাগচীর তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য, ‘‘একমাত্র আস্থা, রাস্তা!’’
সন্দীপ ও অভিজিতের জামিনের পরে এই মামলায় সিবিআই তদন্তের দাবি নিয়েই কটাক্ষ করেছেন তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ। পাল্টা প্রশ্ন তুলে তিনি বলেছেন, ‘‘যাঁরা কলকাতা পুলিশকে অযথা কাঠগড়ায় তুলে সিবিআইকে নিমন্ত্রণ করে এনেছেন, উত্তর দিতে হবে তাঁদেরই!’’ সেই সঙ্গেই তাঁর মন্তব্য, ‘‘নিজেদের ভাবনাকে সমাজমাধ্যমে তুলে ধরা যায় কিন্তু তা যে আইনে গ্রাহ্য হয় না, তা-ই প্রমাণ হল। ময়না তদন্তের সময়ে যে জুনিয়র চিকিৎসকেরা সই করেছিলেন, প্রমাণ হয়ে গেল পরে তাঁরাও নাটক করেছেন!’’ প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থের প্রসঙ্গে তিনি অবশ্য বলেন, ‘‘জামিনের আর্জির জানানোর অধিকার সব বিচারাধীনের আছে। আদালত সেই সিদ্ধান্ত নেবে।’’
কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের ‘যোগসাজশে’ সিবিআই আর জি কর-কাণ্ডে দুই অভিযুক্তের বিরুদ্ধে যথাযথ চার্জশিট দাখিল করেনি এবং ন্যায়-বিচারের প্রতি ‘জঘন্য উপহাস’ হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন এসইউসি-র সাধারণ সম্পাদক প্রভাস ঘোষ। সিপিআই (এম-এল) লিবারেশনের নেতা পার্থ ঘোষেরও মন্তব্য, ‘‘সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি যে বলতেন তদন্ত সঠিক পথে চলছে, এই তার নমুনা! সিবিআই কী তদন্ত করল চার মাস ধরে!’’