বেহাল আর আহমেদ ডেন্টাল

দাঁত নড়ছে হাসপাতালেরই, উদাসীন সরকার

পরিকাঠামোর অভাবে মরণাপন্ন রোগীরা হাসপাতালে ভর্তি হতে পারছেন না। দু’শোরও বেশি রোগীর অস্ত্রোপচার আটকে। তবু হেলদোল নেই সরকারি তরফে। বরং অবস্থা যে অদূর ভবিষ্যতেও বদলাবে না, পরোক্ষে তা-ই জানাল স্বাস্থ্য দফতর। বিভাগীয় যুগ্মসচিব বললেন, ‘‘আগে রুটি খাওয়ার ব্যবস্থা হোক। কেকের কথা পরে ভাবা যাবে!’’

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ মে ২০১৫ ০৩:৫১
Share:

পরিকাঠামোর অভাবে মরণাপন্ন রোগীরা হাসপাতালে ভর্তি হতে পারছেন না। দু’শোরও বেশি রোগীর অস্ত্রোপচার আটকে। তবু হেলদোল নেই সরকারি তরফে। বরং অবস্থা যে অদূর ভবিষ্যতেও বদলাবে না, পরোক্ষে তা-ই জানাল স্বাস্থ্য দফতর। বিভাগীয় যুগ্মসচিব বললেন, ‘‘আগে রুটি খাওয়ার ব্যবস্থা হোক। কেকের কথা পরে ভাবা যাবে!’’

Advertisement

মন্তব্যের লক্ষ্য—রাজ্যের পয়লা নম্বর ডেন্টাল মেডিক্যাল কলেজ আর আহমেদ হাসপাতাল। মন্তব্য, রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের যুগ্মসচিব (ডেন্টাল) রবীন মাইতির।

কিন্তু হঠাৎ রুটি-কেকের গল্প কেন কর্তার মুখে?

Advertisement

আক্ষরিক অর্থেই আজ বেহাল দশা রাজ্যের দাঁত ও মুখের চিকিৎসার প্রধান হাসপাতালের। ‘আর আহমেদ ডেন্টাল মেডিক্যাল কলেজ’ রাজ্যের একমাত্র রেফারাল কেন্দ্রও বটে। অথচ এখানেই ইন্ডোর বেডের সংখ্যা সাকুল্যে ১০। অপারেশন থিয়েটার মোটে একটি। অস্তিত্বই নেই ‘ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিট’-এর (আইটিইউ)। পরিকাঠামো উন্নতির কোনও ইঙ্গিতও নেই।

কিন্তু কেন নেই? এর উত্তর দিতে গিয়েই রুটি-কেকের প্রসঙ্গ টানেন রবীনবাবু। বলেন, ‘‘ইচ্ছে থাকলেও অনেক কিছু করা যায় না। এমবিবিএস চিকিৎসক, অ্যানাসথেসিস্ট, নার্স, চতুর্থ শ্রেণির কর্মীর এমন আকাল যে, দশটা বেড চালাতেই নাজেহাল হচ্ছি। আরও বেড বা আইসিইউ খুললে চলবে কী করে? আগে এইটুকু তো চলুক।’’ অর্থাৎ, কেকের কথা ভাবা হবে পরে, আপাতত কাজ চলুক রুটিতেই।

খোদ স্বাস্থ্যকর্তার মুখেই এ কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে জলপাইগুড়ির বাসিন্দা দশম শ্রেণির ছাত্রী খাদিজা। গত আট মাস ধরে অস্ত্রোপচারের জন্য অপেক্ষা করে মুখের ক্যানসারে আক্রান্ত খাদিজার নাম এখন ওয়েটিং লিস্টের ৬৫ নম্বরে। একই রকম দিশাহারা মালদহের মহানন্দাপল্লির মালতী মণ্ডল, কলকাতার বড়বাজারের মঞ্জু সিংহ, হাতিবাগানের ষষ্ঠী দাস, বর্ধমানের শম্মা দেবীর মতো অসংখ্য রোগী।

এঁদের কারও মুখের ক্যানসার, কারও নাক, দাঁত, জিভ বা মুখে মারাত্মক আকার নিয়েছে টিউমার। অধিকাংশেরই জরুরি অস্ত্রোপচার প্রয়োজন। কিন্তু তার বদলে জুটছে ওয়েটিং লিস্টের এক-একটা নম্বর। অপেক্ষার তালিকায় কেউ ১৩২ নম্বরে, কেউ ৬৫, কেউ বা ৭৬-এ।

তবু কেন গা-ছাড়া মনোভাব স্বাস্থ্যকর্তাদের?

রাজ্যের স্বাস্থ্যসচিব মলয় দে এ নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি। স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘কিছু দিন বিধানসভার অধিবেশন চলবে। এর মধ্যে স্বাস্থ্য নিয়ে কিছু বলতে পারব না।’’

এ দিকে, মুখের ক্যানসারে রোগীর সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে রাজ্যে। এই হাসপাতালেই প্রতিদিন অন্তত ৫০ জন এমন ক্যানসার আক্রান্ত আসেন, যাঁদের অন্তত ১০-১২ জনের অবিলম্বে অস্ত্রোপচার প্রয়োজন। কিন্তু শয্যা খালি নেই। এ ভাবেই হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের অপেক্ষার তালিকায় চলে গিয়েছেন ২৬৩ জন। এই বেহাল দশা অবশ্য হালের নয়। ২০১৪ সালে অস্ত্রোপচারের জন্য ২৬৯ রোগী নাম লিখিয়েছিলেন। তার মধ্যে ৪৯ জন রোগীর এখনও অস্ত্রোপচার বাকি রয়েছে।

বরাত জোরে অস্ত্রোপচার হলেও, প্রাণের ভয় কিন্তু কাটছে না। কারণ, আইসিইউ নেই হাসপাতালে। অর্থাৎ অস্ত্রোপচারের পর রোগীর অবস্থা হঠাৎ খারাপ হলে পার্শ্ববর্তী নীলরতন সরকার হাসপাতাল বা অন্য কোথাও ছোটা ছাড়া উপায় নেই। অভিযোগ, তাই অস্ত্রোপচারের আগেই রোগীকে দিয়ে ‘বন্ড’ সই করানো হয়। যেখানে পরিষ্কার লেখা থাকে, হাসপাতালে যথাযথ পরিকাঠামো নেই জেনেই তাঁরা রাজি হচ্ছেন অস্ত্রোপচারে।

‘ইন্ডিয়ান ডেন্টাল অ্যাসোসিয়েশন’-এর রাজ্য সম্পাদক তথা এই হাসপাতালের সার্জন রাজু বিশ্বাস জানিয়েছেন, নীলরতনের পাশে ৫.৫৫ একর জমিতে আর আহমেদ হাসপাতালের দু’টি ভবন তৈরির পরিকল্পনা হয়েছিল। ২০১০-এ একটি প্রকল্পের উদ্বোধন করেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। ২০১২ সালে একটি ভবন চালুও হয়। কিন্তু তার পরেও শয্যা বা আইটিইউ তৈরি হয়নি। চেষ্টা চলছে। হাসপাতালের অধ্যক্ষ তপন গিরি-র কথায়, ‘‘দুর্ভাগ্যবশত গত কয়েক বছরে সত্যিই কোনও কাজ হয়নি। কয়েক মাস হল এখানে এসেছি। চেষ্টা করছি অবস্থা পাল্টাতে। আরও কয়েক মাস সময় লাগবে।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement