গত সেপ্টেম্বর মাস থেকে রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা বা ডিএমই-র পদ খালি পড়ে রয়েছে। —প্রতীকী চিত্র।
রাজ্যে ডাক্তারি শিক্ষার প্রধান কর্তার পদ গত দু’মাস ধরে শূন্য! গত সেপ্টেম্বর মাস থেকে রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা বা ডিএমই-র পদ খালি পড়ে রয়েছে। আর জি কর-কাণ্ডের পরে শুরু হওয়া জুনিয়র চিকিৎসকদের কর্মবিরতির সময়ে, গত ১৭ সেপ্টেম্বর আন্দোলনকারীদের দাবি মেনে রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা ও স্বাস্থ্য-অধিকর্তা (ডিএইচএস)-কে সরিয়ে দিয়েছিলেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এর পরে স্বাস্থ্য-অধিকর্তার পদে নতুন নিয়োগ হলেও এখনও পর্যন্ত স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তার মতো গুরুত্বপূর্ণ শীর্ষ পদে কাউকে বসানো হয়নি।
এর জেরে মেডিক্যাল পঠনপাঠন ও শিক্ষক-চিকিৎসকদের নিয়োগ-বদলি সংক্রান্ত কাজে প্রতি পদক্ষেপে মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষেরা ঠোক্কর খাচ্ছেন এবং কাজ আটকে থাকছে বলে অভিযোগ। সংশ্লিষ্ট কাগজপত্রে কে সই করবেন, সেটাই স্পষ্ট করে জানাতে পারছেন না স্বাস্থ্যকর্তারা। অভিযোগ, পরিস্থিতি অনেকটা রাজ্যের স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেখানেও দীর্ঘদিন উপাচার্য পদ খালি থাকায় কাজকর্ম লাটে উঠেছিল বলে অভিযোগ। দফতরের বিভিন্ন গোষ্ঠীর লড়াইয়ে কেউ উপাচার্য হতে পারছিলেন না।
যদিও রাজ্যের স্বাস্থ্যসচিব নারায়ণস্বরূপ নিগমের দাবি, ‘‘এখন ডিএমই কেউ না থাকলেও যুগ্ম ডিএমই কৌশিক কর এবং ওএসডি (স্বাস্থ্য শিক্ষা) আশিস বিশ্বাস রয়েছেন। তাঁরাই কাজ দেখছেন। ডিএমই-ও দ্রুত নিয়োগ করা হবে।’’স্বাস্থ্যসচিবের কাছে জানতে চাওয়া হয়, যুগ্ম ডিএমই এবং ওএসডি-র মধ্যে কে ডিএমই-র কাছে পাঠানো নথিপত্রে সই করছেন? সরাসরি এর উত্তর না দিয়ে সচিবের জবাব, ‘‘সইয়ের জন্য কাজ আটকে থাকে না।আগেও অনেক বার ডিএমই-র পদ শূন্য ছিল, তখনও কাজ চলেছে, এখনও চলবে।’’
যদিও রাজ্যের বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষেরা সম্পূর্ণ অন্য কথা বলছেন। তাঁদের কথায়, ‘‘কম্পিউটারে ই-ফাইলে ডিএমই-র নামের জায়গায় ক্লিক করলেই ওএসডি আশিস বিশ্বাসের নাম দেখা যাচ্ছে। অথচ, খাতায়কলমে তাঁকে ডিএমই-র দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। ফলে তিনি সই করতে পারছেন না। এতে মেডিক্যাল পঠনপাঠন, সিলেবাস, পঠনপাঠনের মানোন্নয়ন সংক্রান্ত যাবতীয় নীতি নির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত থমকে রয়েছে। শিক্ষক-চিকিৎসকদের অনেক নথিও ফাইলবন্দি হয়ে রয়েছে। স্বাস্থ্য দফতর কখনও ডিএমই ছাড়া চলতে পারে?’’স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, ওই পদে কাউকে না বসানোর পিছনে রয়েছে সেই উত্তরবঙ্গ লবির চিকিৎসকদের সঙ্গে দক্ষিণের চিকিৎসকদের লবির লড়াইয়ের বৃত্তান্ত। আর জি কর-কাণ্ডের জেরে বিষয়টি আরও জটিল হয়েছে।
ডিএমই-র পদ নিয়ে গত বছর থেকেই উত্তরবঙ্গ লবি, অর্থাৎ মূলত তৃণমূলের চিকিৎসক-বিধায়ক সুদীপ্ত রায়-পন্থীদের সঙ্গে আর এক চিকিৎসক-নেতা শান্তনু সেন-পন্থীদের তুমুল টানাপড়েনের সূত্রপাত। ২০২৩ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ডিএমই পদে ইন্টারভিউ হয় ১৩ জনের। তার মধ্যে আর জি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষও ছিলেন। কিন্তু সেই ইন্টারভিউয়ের কোনও ফলাফল ঘোষণা করা হয়নি, আবার তা বাতিলও করা হয়নি। অথচ, ফের ডিএমই পদের জন্য ২০২৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি আট জনের ইন্টারভিউ নেওয়া হয়। তখন নির্বাচিত হন উত্তরবঙ্গ লবি তথা সুদীপ্ত রায় ঘনিষ্ঠ, বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ কৌস্তভ নায়েক।
সেই নিয়োগ নিয়ে তুলকালাম শুরু হয়। অভিযোগ ওঠে, বহু বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সিনিয়র অধ্যক্ষেরা থাকতে নিয়ম-বহির্ভূত ভাবে কৌস্তভকে বাছা হয়েছে। এর পরে আর জি কর-কাণ্ডের জেরে ডিএমই-কে সরানোর দাবি তোলেন আন্দোলনকারীরা। কৌস্তভ সরে যাওয়ার পরে এক্সটেনশনে থাকা বিশেষ সচিব অনিরুদ্ধ নিয়োগীকে ডিএমই-র অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু এর ২০ দিনের মধ্যে তাঁর নতুন এক্সটেনশন অর্ডার বেরোয়। সেখানে তাঁকে আর ডিএমই-র দায়িত্ব দেওয়া হয়নি।
কলকাতার এক মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষের কথায়, ‘‘স্বাস্থ্য ভবনের অন্দরে চোরাগোপ্তা ভাবে এখনও উত্তরবঙ্গ লবির প্রবল প্রভাব। তারা নিজেদের লোককে ডিএমই করতে চাইছে। আবার আর জি কর-কাণ্ডের সঙ্গে উত্তরবঙ্গ লবির নাম জড়িয়ে যাওয়ায় সেই লবির কাউকে ডিএমই করলে ফের আন্দোলনকারীরা সরব হতে পারেন, এই আশঙ্কায় রয়েছেন স্বাস্থ্যকর্তারা। ফলে তাঁরা সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না।’’ আর জি কর আন্দোলনের অন্যতম মুখ, চিকিৎসক অনিকেত মাহাতো বলেন, ‘‘কী আর বলা যায় এটা নিয়ে। এইটুকুই শুধু বলতে পারি যে, মেডিক্যাল পঠনপাঠনের স্বার্থে দ্রুত স্থায়ী ডিএমই নিয়োগ করা হোক।’’