এসএসকেএমে অস্ত্রোপচারের পরে ন’মাসের সেই শিশু। —নিজস্ব চিত্র।
প্রথম বার সরকার গঠনের সময়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিশ্রুতি ছিল, প্রত্যেক জেলায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কলকাতার ধাঁচে তুলে আনা হবে। গ্রামের মানুষকে হন্যে হয়ে যেন কলকাতায় ছুটতে না হয়, তা নিশ্চিত করা হবে বলেও জানিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। দ্বিতীয় সরকারের সূচনাতেও ঘুরেফিরে এসেছে সেই একই প্রতিশ্রুতি। কিন্তু তার পরেও সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা যে এখনও সেই কলকাতাকেন্দ্রিকই থেকে গিয়েছে, আরও এক বার তার প্রমাণ মিলল পুরুলিয়ার মানবাজারের ন’মাসের শিশু জয়দীপ মাহাতোকে নিয়ে টানাপড়েনের ঘটনায়।
কী হয়েছিল জয়দীপের?
গত ৭ জুন শ্বাসনালীতে বাদাম আটকে গিয়েছিল তার। পরিবারের লোকেরা কী করবেন বুঝতে না পেরে প্রথমে নিয়ে যান মানবাজার গ্রামীণ হাসপাতালে। সেখান থেকে পত্রপাঠ পাঠিয়ে দেওয়া হয় পুরুলিয়া জেলা হাসপাতালে। দম আটকে তখন এতটাই ছটফট করছিল জয়দীপ যে বাবা-মা ভেবেছিলেন, হয়তো সব শেষ হয়ে যাবে। জেলা হাসপাতালের ডাক্তারদের হাতেপায়ে ধরেছিলেন তাঁরা। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি। ডাক্তারবাবুরা জানিয়েছিলেন, তাঁদের কাছে কোনও পরিকাঠামোই নেই।
অতএব জয়দীপকে নিয়ে যাওয়া হয় বাঁকুড়া সম্মিলনী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। ৮ জুন যখন জয়দীপকে বাঁকুড়ায় নিয়ে যাওয়া হয় সেখানকার চিকিৎসকেরাও হাত তুলে নেন। বলা হয়, পরিকাঠামো নেই। হাসপাতালের কাগজে লিখে দেওয়া হয়, এসএসকেএমের মতো বড় কোনও কেন্দ্রে গেলেই মিলতে পারে চিকিৎসা। রাতটা বাঁকুড়ায় কাটিয়ে সন্তানকে বুকে আঁকড়ে ৯ তারিখ কলকাতায় পৌঁছন মাহাতো পরিবার। চাষের কাজ করে সংসার চালানো জয়দীপের বাবার কাছে গাড়ি ভাড়া করার টাকাটুকুও ছিল না। মুমূর্ষু বাচ্চাকে নিয়ে ট্রেনেই কলকাতায় আসেন তাঁরা।
এসএসকেএমে পৌঁছে জরুরি অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা হয় ঠিকই, কিন্তু তত ক্ষণে সেই অস্ত্রোপচারের ঝক্কি সামলানোর মতো জীবনীশক্তি অবশিষ্ট ছিল না একরত্তি বাচ্চার। অপারেশন টেবিলেই এমন ধুঁকতে থাকে সে, যে দ্রুত তাকে ভেন্টিলেটরে দিতে হয়। টানা ছ’দিন ভেন্টিলেটরে থাকার পরে বৃহস্পতিবার তাকে ভেন্টিলেটর থেকে বার করতে পেরেছেন ডাক্তাররা। এসএসকেএমের ইএনটি এবং পেডিয়াট্রিক ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের চিকিৎসকের মিলিত চেষ্টায় হাসি ফুটেছে বাবা-মায়ের মুখে।
কিন্তু জীবন ফিরে পাওয়ার এই ঘটনাকে ব্যতিক্রমী বলছেন এসএসকেএমের চিকিৎসকেরাই। পেডিয়াট্রিক বিভাগের এক চিকিৎসকের কথায়, ‘‘জেলায় মেডিক্যাল কলেজে রাখার অর্থ তা হলে কী? শিশুটির ব্রঙ্কোস্কোপি করার দরকার ছিল। কেন লাখ দুয়েক টাকার সেই যন্ত্রটিও জেলার মেডিক্যাল কলেজে থাকবে না? যা পরিস্থিতি ছিল, তাতে ন’মাসের ওই বাচ্চার কোনও ভাবেই বাঁচার কথা নয়। স্রেফ বরাতজোরে বাঁচানো গিয়েছে। এমন অনেক ক্ষেত্রে রাস্তাতেই সব শেষ হয়ে যায়।’’
কেন পুরুলিয়ার মানবাজার থেকে কলকাতায় আসতে হল? পুরুলিয়া জেলা হাসপাতাল এবং বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, তাঁদের কাছে ওই যন্ত্র এবং তা ব্যবহারে প্রশিক্ষিত ডাক্তার নেই। কেন নেই? তাঁরা কি এই প্রয়োজনীয়তার কথা কখনও স্বাস্থ্যভবনে জানিয়েছিলেন? তাঁরা স্বীকার করেন, জানানো হয়নি।
এসএসকেএমের ইএনটি বিভাগের প্রধান চিকিৎসক অরুণাভ সেনগুপ্ত জানান, শিশুটি যখন তাঁদের কাছে আসে তখন সে সম্পূর্ণ নীল হয়ে গিয়েছে। শ্বাসনালীতে আটকে থাকা বাদাম ফুলে ঢোল। জরুরি ভিত্তিতে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গিয়ে ব্রঙ্কোস্কোপি করেও বাদাম বার করা যায়নি। ফুলে থাকা বাদামের শুধু খোসাটুকুই বেরিয়েছিল। তিনি বলেন, ‘‘বাচ্চাটা যে কোনও মুহূর্তে শেষ হয়ে যেত। দম আটকে গিয়েছিল। আমরা তাই ওর গলার কাছে খানিকটা অংশ কেটে দিই অর্থাৎ ট্রাকিওস্টোমি করা হয়। ইতিমধ্যেই ভেন্টিলেশনে দিয়ে দিতে হয় ওকে। আমরা সেই অবস্থাতেই ১০ তারিখ আবার চেষ্টা করি। কোনওমতে বাদামটি বেরোয়। কিন্তু তার পরেও ও বাঁচবে ভাবিনি। টানা ছ’দিন ভেন্টিলেটরে থাকার পরে আজ আমরা ওকে ভেন্টিলেটর থেকে বার করতে পারলাম।’’ আপাতত এসএসকেএমের পেডিয়াট্রিক ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটেই রয়েছে জয়দীপ।
তার বাবা উত্তম মাহাতো বলেন, ‘‘মনে হচ্ছিল আমাদের কোলেই যে কোনও সময়ে ছেলেটা মরে যাবে। পুরুলিয়া আর বাঁকুড়ার সব চেয়ে বড় সরকারি হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম। সেখানকার ডাক্তারবাবুরা বললেন, তাঁদের হাত-পা বাঁধা। সব বড় চিকিৎসা নাকি কলকাতাতেই হয়। আমাদের মতো গরিব মানুষেরা বিপদে তা হলে কোথায় যাবে? তা ছা়ড়া সব সময়ে কি কলকাতা পৌঁছনোর মতো সময়টুকুও হাতে থাকে?’’
চিকিৎসা পরিষেবার বিকেন্দ্রীকরণের প্রতিশ্রুতি কি তা হলে শুধু কথার কথা? স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, ‘‘আমরা সব রকম সাহায্য করতে প্রস্তুত। কিন্তু কোথায় কী দরকার সেটা তো সংশ্লিষ্ট হাসপাতালগুলিকেই বলতে হবে। আদায় করে নিতে হবে। মেডিক্যাল কলেজগুলির অধ্যক্ষদের সঙ্গে বৈঠক করে ফের এ ব্যাপারে কথা বলব। যে কোনও মূল্যে হোক না কেন, পরিস্থিতি বদলাতেই হবে।’’