ভোট চলছে। অথচ প্রিসাইডিং অফিসার গুটিসুটি মেরে শুয়ে রয়েছেন অন্য ঘরে। আর তাঁর চেয়ারে বসে ভোট পরিচালনা করছেন এলাকারই এক তৃণমূল নেতা।
এবিপি আনন্দের সৌজন্যে কামদুনির এই ভোট-দৃশ্য দেখলেন দেশের মানুষ। সেই কামদুনি, ১১ মাস আগে পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফেরার সময় এক ছাত্রীকে গণধর্ষণ করে খুনের ঘটনায় যার নাম খবরের শিরোনামে চলে এসেছিল। এ ছবি দেখার পরেই স্নেহাশিস ঘোষ নামে ওই প্রিসাইডিং অফিসারকে সরিয়ে দেয় নির্বাচন কমিশন।
জেলাশাসক ওঙ্কার সিংহ মিনা বলেন, “কামদুনির ওই ঘটনায় প্রাথমিক তদন্তে প্রিসাইডিং অফিসারের গাফিলতি প্রমাণিত হয়েছে। তবে ওই ব্যক্তি বহিরাগত না এজেন্ট তার তদন্ত চলছে।”
বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্রের অধীন কামদুনিতে ওই বুথে প্রিসাইডিং অফিসারে চেয়ারে বসে যিনি ভোট পরিচালনা করছিলেন তিনি কে? এলাকার মানুষই জানিয়েছেন, ওই তৃণমূল নেতার নাম সোনা ঘোষ। কী বলছেন তিনি? সন্ধেয় সোনাবাবু বলেন, “আমি এজেন্ট হিসেবে ঘরে ছিলাম। প্রিসাইডিং অফিসার অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁর শুশ্রষা করছিলাম।”
তার কিছু আগেই অবশ্য কামদুনির ওই বুথে গিয়ে দেখা যায়, সোনা ঘোষ ভোট কেন্দ্রের বাইরে দাঁড়িয়ে যাঁরা ভোট দিতে এসেছেন, তাঁদের সঙ্গে কথা বলছেন। ভোট কেন্দ্রের ভিতরে তৃণমূলের নির্বাচনী এজেন্ট হিসেবে রয়েছেন সুভাষ নস্কর নামে এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, “আমিই তৃণমূল এজেন্ট।” তা হলে সোনা ঘোষ বুথের মধ্যে ঢুকলেন কী করে? জেলাশাসক বলেন, “বিষয়টি কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের কাছে জানতে চাওয়া হচ্ছে।”
কামদুনির ওই বুথেই এ দিন এসে পর পর ভোট দেন নিহত গণধর্ষিতার বাবা-মা, দাদা, টুম্পা কয়াল, মৌসুমি কয়ালরা। টুম্পা বলেন, “এখানে তৃণমূল ছাড়া অন্য দলের এজেন্ট বসেনি।”
মৌসুমি বলেন, “বদল নয়, বদলাই হয়েছে। আগে সিপিএমের ছাড়া অন্য এজেন্ট থাকতে পারত না। এখন সেটাই করছে তৃণমূল।”
একই ছবি শাসনেও। নির্বাচন কমিশনের বিশেষ পর্যবেক্ষক সুধীরকুমার রাকেশকে নিয়ে চলে যাচ্ছে বিশাল কনভয়। ভোট কেমন দেখছেন প্রশ্ন করতেই রাকেশের পাল্টা প্রশ্ন, “আপনারাই বলুন।” পাশ থেকে এক বৃদ্ধ মাথা নাড়িয়ে নিজের মনেই বলে উঠলেন, “খুব শান্ত। শান্তিতেই ভোট হচ্ছে।”
সওয়া তিনটে নাগাদ শাসনের দুগদিয়া পলতাডাঙা হাই স্কুলে গিয়ে দেখা গেল, সব শান্ত-স্নিগ্ধ। কে বলবে, এখানে ভোট হচ্ছে! শাসনের মতো ‘উপদ্রুত’ এলাকা হলেও কোনও আধা সামরিক বাহিনী নেই। তবে খাকি পোশাকের পুলিশ রয়েছে। অথচ বছর তিনেক আগে এই সুধীরকুমারের নির্দেশেই এই বুথের পাশে বালি, সিমেন্টের বস্তা ফেলে এসএলআর উঁচিয়ে পাহারা দিয়েছিল আধা সামরিক বাহিনী। এ বার শুধু স্কুলের আগে এক তাঁবুতে তৃণমূলের কিছু ছেলে। এরা ছাড়া খাঁ খাঁ করছে বাকি শাসন। ভোটের লাইনও নেই। ঠিক যেমন দেখা যেত একদা বাম আমলে। এক জন ভোটারও নেই লাইনে।
বুথের ভিতরে একা বসে তৃণমূলের এজেন্ট মহম্মদ আলম। বললেন, “শাসনের কোনও বুথেই বিরোধীদের এজেন্ট দেখতে পাবেন না। ওঁরা এজেন্টই দিতে পারেনি।” লোক কোথায়? বুথের প্রিসাইডিং অফিসার তন্ময় মণ্ডল বলেন, “গরম তো, সকাল সকাল ভোট পড়ে গিয়েছে। ৯৬৩টি ভোটের মধ্যে ৫৮০টি।”
শাসনের বেলিয়াঘাটায় সকাল-সকাল সপরিবার ভোট দিতে গিয়েছিলেন প্রাচী মণ্ডল। দুপুরে বারাসত হাসপাতালে দাঁড়িয়ে ওই বৃদ্ধা বলেন, “আমরা সিপিএম করি। বিধানসভা ভোটের পর থেকে বাড়ি ছাড়া। নির্বাচন কমিশনের অভয় পেয়ে ভাই অজিত, ছেলে পরেশকে নিয়ে গ্রামে ভোট দিতে গিয়েছিলাম। ওদের এমন মার মেরেছে যে এখন হাসপাতালে আনতে হয়েছে।”
যেন সেই পুরোনো ছবি। বিরোধীরা বলছে, “রিগিং হয়েছে, ভয় দেখিয়েছে, আমাদের এজেন্টই দিতে দেয়নি।”
শাসক দলের জবাব, ‘‘এজেন্ট দেওয়ার মতো লোকবল কোথায়?’’ বয়ান এক। পাল্টেছে সময় ও পক্ষ। ঘরে বসেই এক সময় শাসনে ভোট পরিচালনা করতেন সিপিএমের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা মজিদ মাস্টার ওরফে মজিদ আলি। প্রাচীদেবীরা সাহস করে এগোলেও মজিদ মাস্টার ভোট দেওয়ার এমন ঝুঁকি নেননি। গোটা দিন কাটিয়েছেন বারাসতে দলের অফিসে বসে। ভোট না দিয়ে শাসনের বাইরে থাকতে যন্ত্রণা হচ্ছে না? মজিদের জবাব, “আমাদের সুদিনেও এমন রিগিং হয়নি। না হলে আমরা হারতাম না। যন্ত্রণা হবে না?”
মধ্যমগ্রামে তখন দলের অফিসে বসে মিষ্টি খাচ্ছেন তৃণমূলের জেলা পর্যবেক্ষক জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। বললেন, “কর্মীদের যত বলছি, আমার সুগার, তবু মিষ্টি দিচ্ছে।” খাদ্যমন্ত্রীর সাফ কথা, “কোনও রিগিং নয়। সবাই মর্জিমতো ভোট দিয়েছেন। মজিদ জানে না। ও শাসনে না ফিরলেই সব শান্তিতে থাকবে।”
সকাল-সকাল মর্জি মতো সপরিবারে নিজের ভোট নিজেই দিয়ে এসেছেন ব্যারাকপুর কেন্দ্রের আমডাঙার ট্যাঙাট্যাঙি গ্রামের সুফিয়াবিবি। গত পঞ্চায়েত ভোটের দিন তৃণমূলের ছেলেদের হাতে খুন হয়েছিলেন তাঁর স্বামী মাদার বক্স আলি। ছেলে কাশেমকে দেখিয়ে সুফিয়া বলেন, “ভোটের দিন মানেই ওঁর বা-জানের মৃত্যুবাষির্কী।” খানিক পরেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বৃদ্ধা আনমনে বলেন, “তবু ভোট দিয়ে এলাম। বাস করতে গেলে ভোটটা দিতেই হয়।”