বিচার পেতে দেরি।
গণধর্ষণের পর ছাত্রী খুনের বিচার চলছে ১৮ বছর ধরে। কখনও হতাশায় এজলাসেই গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করছেন বিচারপ্রার্থী।
এই মুহূর্তে উত্তর ২৪ পরগনার বিভিন্ন আদালতে তিন লক্ষাধিক মামলা ঝুলে রয়েছে, দাবি সরকারি কৌঁসুলিদের। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বারাসত জেলা আদালতে, যেখানে বারাসত মহকুমার মামলাগুলি চলে। বাকি চার মহকুমা বনগাঁ, বসিরহাট, ব্যারাকপুর ও বিধাননগরেও আদালত রয়েছে। সেগুলি থেকেও জেলা আদালতে মামলা আসে। জেলার এক মাত্র নারকোটিক (মাদক) আদালতও সেখানে। ফলে শুনানির দিন পেতে অভিযুক্ত ও কৌঁসুলিরা হয়রান হয়ে যান। মামলার পাহাড় জমে যাওয়ায় টানা ৩৬ দিন কর্মবিরতিও করেছেন আইনজীবীরা।
আইনজীবীদের বড় অংশের দাবি, শুধু বারাসত আদালতেই লক্ষাধিক মামলা ঝুলে রয়েছে। জেলা বার অ্যাসোসিয়শনের প্রাক্তন সম্পাদক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মতে, “অবস্থা একেবারে বিস্ফোরক পর্যায়ে চলে গিয়েছে। বারাসতের ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে হাজার-হাজার মামলা পড়ে। নারকোটিক আদালতে কেউ-কেউ চার বছর ধরে কারাগারে রয়েছে, অথচ বিচার হচ্ছে না। জামিনও মিলছে না।” ডিস্ট্রিক্ট অ্যাডভোকেট বার অ্যাসোসিয়েশনের প্রাক্তন সভাপতি রণজিৎ সাহার অভিযোগ, “মামলার পরের সাক্ষ্যের দিন পড়ছে দেড় বছর বাদে। শূন্য পদে বিচারক চেয়ে আমরা আন্দোলন করেছি। সুরাহা হয়নি আজও।” অত্যাবশ্যকীয় পণ্যবিধির মামলাগুলিও এখন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আসছে। জেলা ছাড়াও উত্তর-পূর্ব কলকাতার বেশ কিছু গুরুত্বপর্ণ মামলা এসে পড়ে রয়েছে। সমস্যায় পড়ে পুলিশ-প্রশাসনও।
মহকুমা আদালতগুলির মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বনগাঁ ও ব্যারাকপুরের। সরকারি কৌঁসুলিরা জানান, বনগাঁ আদালতে বছরে চার হাজারের মতো নতুন মামলার বিচার হয়। তার প্রায় ২০ শতাংশই মহিলা নির্যাতন সংক্রান্ত। বছরের পর বছর ধরে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মামলা এবং ধর্ষণ করে খুনের মামলা ঝুলে রয়েছে। যেমন, ১৯৯৯ সালের ১২ জুন বাড়ি ফেরার পথে গাইঘাটার ঘোঁজা বাজারে গণধর্ষিতা হয়েছিল এক কিশোরী। সেই মামলা এখনও চলছে। ব্যারাকপুর আদালতে বিচারকের অভাবে কুখ্যাত অপরাধী শেখ বাচ্চুর গুরুত্বপূর্ণ মামলাও পড়ে রয়েছে। ফলে অভিযুক্তরা হাইকোর্টে গিয়ে জামিন পেয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ সরকারি কৌঁসুলিদের।
আইনজীবীরা জানালেন, বারাসত জেলা আদালতে জমে রয়েছে প্রায় এক লক্ষ মামলা। সাত নম্বর অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা বিচারক, ৪ ও ৫ নম্বর ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে বিচারক নেই।
ভারপ্রাপ্ত সরকারি কৌঁসুলি শান্তময় বসু বলেন, “৩ নম্বর অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা বিচারকের শূন্যপদে সোমবারই বিচারক যোগ দিয়েছেন। কিন্তু রাজীব হত্যাকাণ্ডের মতো গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলিতে দেরি হচ্ছে।”
ব্যারাকপুর আদালতে জমে রয়েছে প্রায় ২৫ হাজার মামলা। চার নম্বর ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টের বিচারক নেই। ভারপ্রাপ্ত সরকারি কৌঁসুলি দেবজ্যোতি দত্ত বলেন, “বিচারক না থাকায় ভাগ্নির শ্লীলতাহানি রুখতে গিয়ে বিশরপাড়ার পুলিশকর্মী অসীম দাম খুনের মতো ২১টি গুরুত্বপূর্ণ মামলা ঝুলে আছে।”
বনগাঁ আদালতে জমে রয়েছে প্রায় ২০ হাজার মামলা। এখানে কোনও বিচারক পদ শূন্য নেই। ভারপ্রাপ্ত সরকারি কৌঁসুলি সমীর দাস বলেন, “মাঝে-মধ্যেই বিচারক পদ শূন্য হয়ে যায়। সুটিয়া গণধর্ষণ, বরুণ হত্যা, গাইঘাটা ধর্ষণ মামলাও ঝুলে আছে।”
কেন এই দশা আদালতগুলির? আইনমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য বলেন, “মামলায় দেরির ব্যাপারে সরকারের কিছু করার থাকে না। ম্যাজিস্ট্রেট পদে পিএসসির মাধ্যমে নিয়োগ হয়। অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা বিচারকের ২৫ শতাংশ পদে হাইকোর্ট নিয়োগ করে। বাকি ৭৫ শতাংশ পদোন্নতি পেয়ে নিযুক্ত হন। উত্তর ২৪ পরগনার ক্ষেত্রে বিচারক নিয়োগে তেমন সমস্যা নেই বলেই আমি জানি।”
বিচারক কম থাকায় প্রত্যেক বিচারককে রোজ প্রচুর মামলাও সামাল দিতে হচ্ছে। তার মাসুল দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। আইনজীবীদের আক্ষেপ, খুন, খুনের চেষ্টা, জাল নোটের কারবার, ডাকাতি, ধর্ষণ বাদে ভারতীয় দণ্ডবিধির প্রায় সব মামলাই ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে হয়। ফলে এক-একটি মামলার পরবর্তী সাক্ষ্যের দিন পড়ছে ১৬ থেকে ১৮ মাস বাদে। বধূ নির্যাতন, খোরপোষের মতো মামলাগুলি ছ’মাসে নিষ্পত্তি হওয়ার কথা। কিন্তু আবেদনের পরে মামলা শুরু হতে লেগে যাচ্ছে এক বছর। নিষ্পত্তি হতে ছ’বছর। আইনজীবীদের প্রশ্ন, প্রায় কোনও মামলারই পরবর্তী দিন আট মাসের আগে মিলছে না। তা হলে কী ভাবে সাধারণ মানুষ বিচার পাবেন?
আদালত ও এক পিতা
বনগাঁর মতিগঞ্জের প্রদীপ মিত্রের জীবনের কাহিনী লিখতে গেলে বোধহয় এমনই শিরোনাম দিতে হবে। পণের জন্য গর্ভবতী কন্যার হত্যার বিচার চেয়ে লড়ে যাচ্ছেন চার বছর। নিম্ন আদালত থেকে সুপ্রিম কোর্ট অবধি ঘুরে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। অন্তিম রায় এখনও মেলেনি।
২০১০ সালের ২৯ মার্চ প্রদীপবাবুর কন্যা দেবশ্রীকে তার শ্বশুরবাড়িতে অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায়। পাঁচ বছর আগে দেবশ্রীর বিয়ে হয়েছিল, বিয়ের পর থেকেই পণের জন্য নির্যাতন হয়েছে তার ওপর। দেবশ্রীর স্বামী ও শ্বশুর-শাশুড়ির নামে মেয়েকে পুড়িয়ে খুন করার অভিযোগ জানান প্রদীপবাবু। অভিযুক্তরা গ্রেফতারও হয়।
বারাসত আদালতে সেই মামলা শুরু হয়। অভিযুক্তরা জামিনের জন্য পাঁচ বার হাইকোর্টে আবেদন করেছিলেন। পরিবহণ ব্যবসায়ী প্রদীপবাবু দুই আদালতে মামলা চালাতে গিয়ে নিজের ট্রাক ও চার বিঘে জমি বিক্রি করে দেন। বনগাঁ থেকে কখনও বারাসতের আদালত, কখনও কলকাতায় হাইকোর্টে নিয়মিত হাজিরা দিতে ভোরে উঠে ট্রেন ধরতেন কন্যাহারা পিতা। বছর তিনেক পরে তিন জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের নির্দেশ দেয় বারাসত আদালত। হাইকোর্টে আবেদন জানিয়ে জামিনও পেয়ে যায় অভিযুক্তরা।
এই রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ফের সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন প্রদীপবাবু। ২ মে সেই আবেদনের ভিত্তিতে অভিযুক্তদের জামিনের আবেদন নাকচ করেছে সর্বোচ্চ আদালত। সেই রায়ে প্রদীপবাবু কিছু স্বস্তি পেয়েছেন। অভিযুক্তরা অবশ্য এখনও অধরা। মামলার আইনজীবী তন্ময় খান বলেন, “এ ধরনের মামলা আরও পাঁচ বছর লাগতে পারে। আবার ২০ বছরও চলতে পারে।” প্রদীপবাবু বলেন, “এই মামলা চালাতে গিয়ে দশ লক্ষেরও বেশি টাকা খরচ হয়েছে। ট্রাক, জমি বিক্রি করে দিয়েছি। কিন্তু পিছু হঠব না। যৌথ সম্পত্তিতে নিজের অংশ বিক্রি করে মামলা চালাব।”
আঠারো বছরে মেলেনি বিচার
আঠারো বছরেও বিচার পেলেন না বনগাঁর রীতা বসুর পরিবার।
১৯৯৬ সালের এপ্রিলে গাইঘাটা থানার গাজনা গ্রামের পাশ থেকে উদ্ধার হয়েছিল রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর স্তরের ছাত্রী রীতার দেহ। তাঁকে ধর্ষণ করে খুনের অভিযোগে তাঁর সহপাঠী গাইঘাটা গাজনা গ্রামের তপন মণ্ডল-সহ তিন জনকে গ্রেফতারও করেছিল পুলিশ। বনগাঁ মহকুমা আদালতে মামলাটি ওঠে। পরে ওই মামলায় জামিনও পেয়ে যায় তারা। কিন্তু রীতার খুনের মামলার বিচার আজও শেষ হয়নি।
এ ব্যাপারে সরকারি কৌঁসুলি সমীর দাস বলেন, “কখনও আদালতে বিচারক নেই। কখনও সাক্ষী আসছেন না। এইসব জটিলতায় এখনও বিচার শেষ হয়নি।”
পুলিশসূত্রে খবর, রীতাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল তপন। রীতা অবশ্য সেই প্রস্তাবে রাজি হননি। পরের দিন বারাসতে এক আত্মীয়ের বাড়িতে যাওয়ার জন্য বেরিয়েছিলেন রীতা। কিন্তু তারপর থেকে আর খোঁজ মিলছিল না রীতার। দু’দিন পরে, ৭ এপ্রিল গাজনা গ্রামের পাশ থেকে উদ্ধার হয় রীতার মৃতদেহ। দেহে অত্যাচারের চিহ্ন ছিল স্পষ্ট। রীতার পরিবার ধর্ষণ ও খুনের অভিযোগ করলে পুলিশ তপন-সহ তিন জনকে গ্রেফতার করে। আর এক অভিযুক্ত অবশ্য এখনও পুলিশের হাতে ধরা পড়েনি।
সেই বিচার আজও শেষ না হওয়ায় হতাশ রীতার পরিবার। মেধাবী ছাত্রীটির মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায় একদিন পাশে দাঁড়িয়েছিলেন পড়শি, আত্মীয়রা। আজ সে ঘটনার কথা ভুলতে বসেছেন তাঁরা। রীতার মা শয্যাশায়ী, কথা বলতেও কষ্ট হয়। অন্য আত্মীয়েরা জানান, ১৮ বছর ধরে মামলার সাক্ষ্য দিতে দিতে ক্লান্ত তাঁরা। বিরক্তি, হতাশাই শুধু শোনা গিয়েছে তাঁদের মুখে। কেন এত দেরি? পুলিশের দাবি, সাক্ষী জোগাড় করতে সমস্যা হচ্ছে, তাই মামলা পিছিয়ে গিয়েছে। তা হলে কবে মিলবে বিচার? সরকারি কৌঁসুলির জবাব, “জানি না।”