ভোটে জিততে তিন বছরে উত্তর ২৪ পরগনায় উন্নয়নমূলক কাজের খতিয়ানকেই হাতিয়ার করেছে তৃণমূল কংগ্রেস। ২০১১ সালের মে থেকে ২০১৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘোষিত প্রকল্পের অগ্রগতি জেলায় কী রকম, তার পরিসংখ্যান দিয়ে জেলা তৃণমূলের তরফে প্রচারপুস্তিকা তৈরি করা হয়েছে। ভোটের প্রচারে সেই পুস্তিকা নিয়েই দোরে দোরে ঘুরছেন দলের নেতা-কর্মীরা।
জেলা তৃণমূল পর্যবেক্ষক তথা রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেন, “গত ৩৪ মাসে মুখ্যমন্ত্রী জেলায় যা উন্নয়ন করেছেন, তা ৩৪ বছরেও হয়নি। মানুষকে প্রভাবিত করার জন্য নয়, মানুষ তো উন্নয়ন নিজেদের চোখেই দেখতে পাচ্ছেন। ওই প্রচারপুস্তিকা ৫০ লক্ষ ছাপানো হচ্ছে। ইতিমধ্যেই ২৫ লক্ষ আমরা হাতে পেয়ে গিয়েছি। জেলার ৫টি লোকসভা কেন্দ্রের প্রতিটি প্রান্তে কর্মীরা বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছেন।”
বিরোধীরা যখন প্রচারে তুলে ধরছেন, জেলায় একের পর এক নারী নির্যাতনের ঘটনা, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি কিংবা সারদা কাণ্ডের প্রসঙ্গ। তখন প্রচারে তৃণমূলের অস্ত্র উন্নয়ন। তৃণমূলের জেলা নেতৃত্বের ব্যাখ্যা, মুখে বড় বড় কথা আর প্রতিশ্রুতিতে মানুষ এখন আর বিশ্বাস করেন না। তাঁরা চান, তাঁদের নিজেদের এলাকার উন্নয়ন চোখের সামনে দেখতে। মুখ্যমন্ত্রী ঠিক সেই কাজটাই করেছেন। মুখ্যমন্ত্রীর সেই উন্নয়নই তাঁরা মানুষের সামনে তুলে ধরছেন। পুস্তিকার প্রথম পাতায় বড় বড় করে লেখা, ‘উন্নয়নের নজির’। বিভিন্ন দফতর ধরে ধরে তিন বছরে জেলায় যা যা উন্নয়ন হয়েছে, পুস্তিকাতে তা তুলে ধরা হয়েছে।
পাল্টা বিরোধী দলগুলিও তৃণমূল রাজ্য সরকারে ক্ষমতায় আসার পরে জেলায় যে ভাবে একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে তা নিয়ে তৃণমূলকে বিঁধে ভোটের প্রচার শুরু করেছে। তাঁদের দাবি, তৃণমূল নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জেলায় উন্নয়নের তালিকা যতটা না বাস্তবে, তার বেশি কথায় ও পরিকল্পনায়। জেলা কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ সমাদ্দার বলেন, “জেলায় উন্নয়ন হয়েছে কাগজে-কলমে। বাস্তবে তা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। যেমন কিছুদিন আগে হাসনাবাদে কাটাখালি নদীর উপরে সেতুর শিলান্যাস করা হয়েছিল। পরে শুনেছি শিলান্যাসের ফলকই উধাও। আসলে মানুষ কথায় নয়, নিজের চোখে উন্নয়ন দেখতে চায়।”
সিপিএমের জেলা সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য নেপালদেব ভট্টাচার্য অবশ্য তৃণমূলের প্রচারপুস্তিকা দেখেননি। তবে তৃণমূলের উন্নয়নের দাবি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “বামেদের আমলে জেলায় যা উন্নয়ন হয়েছিল, তার পর আর কিছু অগ্রগতি হয়নি। ভেঙে পড়েছে জেলার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা।” জেলা বিজেপির সাধারণ সম্পাদক বিপ্লব হালদারের কথায়, “উন্নয়ন যেটা হয়েছে তা হল, জেলায় প্রচুর পরিমাণে নারী-ধর্ষণ, নারী-নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে যাওয়া। নারীদের উন্নয়ন মানে তাঁরা ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন। বনগাঁ থেকে হাবরা পর্যন্ত ত্রিফলা আলো লাগিয়েও তুলে নেওয়া হয়েছে। এটাই আমাদের কাছে উন্নয়ন।”
উন্নয়ন নিয়ে বিরোধীদের মন্তব্য নিয়ে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, “সিপিএম নেতারা চাইলে আমাদের কর্মীরা তাঁদের কাছে উন্নয়নের খতিয়ান পাঠিয়ে দিতে পারেন। তাতে ওঁদের মাথা আরও ঘুরে যাবে!”
কী বলছেন জেলার মানুষ?
উন্নয়ন নিয়ে শাসক দল ও বিরোধীদের তরজা প্রসঙ্গে হাবরার এক স্কুল শিক্ষকের কথায়, “নাগরিক পরিষেবার ক্ষেত্রে রাস্তা, নিকাশি নিয়ে উন্নয়ন তেমন চোখে পড়েনি। তবে বনগাঁ ও বসিরহাট হাসপাতালে নবজাতকদের চিকিৎসায় এসএনসিইউ হওয়াটা অবশ্যই ভাল দিক।” বসিরহাটের এক ব্যবসায়ীর কথায়, “হাসনাবাদে কাটাখালি নদীর উপর সেতু তৈরি নিয়ে আগের সরকারের আমলে গড়িমসি ছিল। বর্তমান সরকারের আমলেও যা শুরু হয়েছে তাতে সেতু আদৌ হবে কি না সন্দেহ।”
উন্নয়ন নিয়ে এমন মিশ্র প্রতিক্রিয়াতেই ঝুলে রয়েছে জেলায় তৃণমূল, সিপিএম, কংগ্রেস, বিজেপি-র ভোটভাগ্য।
যা হয়েছে
যা হয়নি
• বনগাঁ মহকুমা হাসপাতালকে ৩০০
শয্যার হাসপাতালে পরিণত করা হয়েছে।
• বনগাঁ ও ব্যারাকপুরে
খাদ্যভবন তৈরি হয়েছে।
• বারাসত জেলা হাসপাতালে
বার্ন ইউনিট চালু হয়েছে।
• চাঁদপাড়া ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কাছে মতুয়াদের ধর্মগুরু প্রমথরঞ্জন ঠাকুরের নামে প্রস্তাবিত কলেজের নির্মাণ চলছে।
• গাইঘাটার দেবীপুরে সরকারি কৃষি খামারে তৈরি হচ্ছে কিষানমাণ্ডি।
• বনগাঁয় ইছামতী নদীর উপর পাকা সেতু শিলান্যাস
হয়েছিল ২০১৩ সালের মার্চ মাসে। একদিকে
মুড়িঘাটা, অন্যদিকে অম্বরপুর। এখন বাঁশের সাঁকো।
• রেলমন্ত্রী থাকাকালীন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বনগাঁ-বাগদা রেলপথ, মছলন্দপুর-স্বরূপনগর রেলপথ, বনগাঁয় রেলের স্টেডিয়ামের শিলান্যাস করেন। কাজ শুরু হয়নি।
• মুকুল রায় রেলমন্ত্রী থাকাকালীন কাঁচরাপাড়ায় রেল কোচ ফ্যাক্টরির শিলান্যাস করেন ২০১২ সালে। কাজই শুরু হয়নি।
• বনগাঁয় মাল্টি সুপার স্পেশালিটি ২১ শয্যার
হাসপাতাল তৈরির ঘোষণা করেছিলেন মমতা
বন্দ্যোপাধ্যায় ২০১২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর। কাজ হয়নি।
• বনগাঁয় আইটিআই, পলিটেকনিক কলেজ হয়নি।