টিন-বাজারের এখনকার চেহারা।--নিজস্ব চিত্র।
রাজকীয়তা হারিয়ে গিয়েছে বহুদিন। তবু দু’শো বছর পার করে আসা শ্রীরামপুরের মফস্বল এলাকার অন্যতম সেরা বাজার হিসাবে নিজের সুনাম ধরে রেখেছে টিন বাজার।
চেহারায় আর পাঁচটা বাজারের মতো নয়। নয় রাস্তার ধারে হঠাৎ কোনও গজিয়ে ওঠা বাজারের মতোও। শ্রীরামপুরের বিখ্যাত এই টিনবাজার তৈরির পিছনে ছিল সুপরিকল্পনা। শ্রীরামপুরে ডেনিস (ডেনমার্ক) আমল নিয়ে গবেষণাকারী অধ্যাপক তপন কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় জানালেন, ডেনিস উপনিবেশ থাকার সময় ডেনিস গভর্নর ওলিবির আমলে ছয় বিঘা জমিতে ওই বাজার তৈরি হয়। বিদেশি কারিগরিতে তৈরি বাজারের লোহার কাঠামোয় এত বছরেও একটুকু মরচে ধরেনি। শুধু বাজার নয়, বড় বড় গুদামও তৈরি করা হয়েছিল সেই সময়। গুদামের ছাদ তৈরি করা হয় টিনের। ডেনিসরা বাজারের নামকরণ করেছিলেন ক্রাউন বাজার। ক্রাউন বাজার কবে থেকে টিনের বাজার হয়ে গেল সে বিষয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা বা বাজার কর্তৃপক্ষ কোনও সুলুকসন্ধান দিতে না পারলেও অনেকেই মনে করেন টিনের চাল থেকেই বাজারের নাম টিন বাজার হয়ে গিয়েছে।
শ্রীরামপুরের ইতিহাস নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চর্চা করা প্রবীণ বাসিন্দা চিকিৎসক অসিত দত্তর কথায়, “শুনেছি এখানে এককালে হাট বসত। সে জন্য এলাকার মানুষ একে হাটবাজারও বলত। মান্যগণ্য মানুষজন বাজার করতে আসতেন। ডেনিসদের ঘরেও এখান থেকে বাজার যেত। শ্রীরামপুরে জাঁকিয়ে বসার পরে নিজেদের প্রয়োজনের তাগিদেই এবং উন্নতমানের পণ্য কেনাবেচার জন্যই ডেনিসরা এই বাজারের পরিকল্পনা করেছিলেন।”
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একে একে অদৃশ্য হয়েছে গুদাম ঘরগুলি। থেকে গিয়েছে মূল বাজার ও তাকে ঘিরে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়া দোকানপাট। টিনবাজার ব্যবসায়ী সমিতির কর্তারা জানান, সব্জি, মাছ, মাংস ও ফল ব্যবসায়ী সব মিলিয়ে ব্যবসায়ীর সংখ্যা প্রায় তিনশো। বর্তমানে আশপাশের বাসিন্দারা তো বটেই গুপ্তিপাড়া, তারকেশ্বর-সহ বিভিন্ন জায়গা থেকেও বাজারে সব্জি, মাছ নিয়ে আসেন চাষিরা।
তবে দিনে দিনে লোকসংখ্যা বেড়েছে। বাজারের পরিকাঠামো নিয়ে ক্রমশ তৈরি হয়েছে ক্ষোভ। টিনবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক তারক দাস বলেন, “এখন বাজারের নিকাশির হাল খুবই শোচনীয়। জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেক মহিলা সবজি, মাছ বেচতে এখানে আসেন। কিন্তু বাজার চত্বরে মহিলাদের জন্য শৌচাগার না থাকায় প্রচণ্ড সমস্যায় পড়তে হয় তাঁদের। আজ পর্যন্ত কোনও শৌচাগার গড়ে ওঠেনি। অথচ জায়গা রয়েছে।” ব্যবসায়ীদের বক্তব্য, বাজারের জন্য নির্দিষ্ট ভ্যাট নেই। বাজারের কাছে ব্লক অফিসের পাশে যাবতীয় উচ্ছিষ্ট ফেলা হয়। কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দারা এতে তীব্র আপত্তি জানিয়েছেন। কিন্তু এ ছাড়া কোনও উপায় নেই। তাই বাধ্য হয়েই লুকিয়ে ওখানে বা অন্যত্র আবর্জনা ফেলতে হয়।” তা ছাড়া রাতের অন্ধকারে বাজারের মধ্যে মদ-গাঁজার আসর বসে বলেও অভিযোগ ব্যবসায়ীদের। তারকবাবু জানান, “বাজারের টিনের শেড জীর্ণ পড়ায় রোদে জলে সমস্যা হচ্ছিল ব্যবসায়ী থেকে ক্রেতা সকলের। কয়েকমাস আগে পুরসভার অনুমতি নিয়ে ব্যবসায়ী সমিতি নিজেদের টাকায় শেড সংস্কার করেছে। আলোর সমস্যাও মিটেছে।”
পুরসভার প্রাক্তন ভাইস চেয়ারম্যান এবং বর্তমান কাউন্সিলর তথা কংগ্রেস নেতা গিরিধারী সাহা বলেন, “বাজারে কিছু সমস্যা রয়েছে। নিকাশি-সহ অন্যান্য পরিকাঠামো ঢেলে সাজা দরকার।”
শ্রীরামপুর কেন্দ্রীয় ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি সুব্রত বসু বলেন, “পুর কর্তৃপক্ষ এগিয়ে এলে অবশ্যই বাজারের খোলনলচে বদলে যাবে।” বাজারের বেহাল পরিকাঠামোর কথা অস্বীকার করেননি শ্রীরামপুরের পুরপ্রধান তৃণমূলের অমিয় মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “ব্যবসায়ী সমিতির লোকজন আমার কাছে এসেছিলেন। কিন্তু এখনও সে ভাবে কিছু আলোচনা হয়নি। তবে শীঘ্রই সব পক্ষকে নিয়ে আলোচনায় বসব। বাজারের পরিকাঠামোর উন্নয়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করা হবে।”