করব, লড়ব...: ম্যাচের আগে দু’দলের সমর্থকেরা। রবিবার, যুবভারতী স্টেডিয়ামের বাইরে। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।
সচরাচর একটা ঘরে সব লোক ধরে না! বাড়ির খাওয়ার ঘরের টিভিটা ছাড়াও খুলে দিতে হয় পাশের ঘরের আদ্যিকালের টিভিটা।
১৯৮৫ সালে এ বাড়িতে প্রথম রঙিন টিভি আসার পর থেকেই তার সামনে পাড়ার অন্তত জনা পনেরো ছেলে-বুড়ো হামলে পড়ে। বাঙালির আবেগের ‘বড় ম্যাচ’ তখনও মুখে-মুখে কেতাদুরস্ত ‘ডার্বি’ তকমা পায়নি। ভবানীপুরের কালীমোহন ব্যানার্জি লেনের বাড়িটায় সেই ট্র্যাডিশন এখনও চলছে।
রবিবার তার সামান্যই নড়চড় হল। কাছেই বিহারী ডাক্তার লেনের প্রবীণ মোহনবাগানি তপন মুখোপাধ্যায়ের আসা হয়নি। পাশের বাড়ির তরুণ তথ্যপ্রযুক্তি-কর্মী, কালীভক্ত মোহনবাগানি সৃজিত দে-ও বুক ঠুকে সল্টলেকের মাঠমুখো হয়েছেন। ঘর ভরা ইস্টবেঙ্গল জনতার মধ্যে সেই ‘পরম শত্রু’দের অনুপস্থিতির জন্য হা-হুতাশই মুখ্য হয়ে উঠল।
গৃহকর্তা রেলের প্রাক্তন ফুটবলার গৌরাঙ্গ কর্মকার, তাঁর মা, ৮৮ বছরের ‘বরিশালি মাইয়া’ লীলাবতী কিংবা পড়শি কবীর রায় ওরফে জগাদার রক্তের রং লাল-হলুদ! তা বলে মোহনবাগানি পড়শিদের সঙ্গে সৌহার্দ্যে ফাঁক নেই। এ দিন ম্যাচের শুরুতে সবুজ-মেরুনের সুসময়ে বেলতলার বাসিন্দা অমল ঘোষ ওরফে মান্নার আহ্লাদে আটখানা আস্ফালনই এ তল্লাট মাতিয়ে রাখল। পরের দিকে নানা অঘটনের ধাক্কায় খানিক মিইয়ে গিয়েছিলেন মিতভাষী মোহনবাগানি। শেষ পর্বে ডিকার সামনে সোনার সুযোগ জলে যেতে তো কপাল চেপে বসে পড়লেন। কাঠবাঙাল অশোক বিশ্বাস তা দেখে বন্ধুকে জড়িয়ে ধরলেন। ‘‘এ কি আজকের বন্ধুত্ব? পঁচাত্তরের সেই পাঁচ গোলের ম্যাচে আমরা দু’জনে ফেন্সিংয়ের ধারে বসেছি। অমলের কান্না সামলে ওকে বাড়িতে নিয়ে এলাম।’’ বেলতলার পুরনো পাড়া ছেড়ে অশোকবাবু এখন বেহালাবাসী। কিন্তু বড় ম্যাচে এ পাড়ায় গৌরাঙ্গের বাড়ি ছেড়ে থাকার কথা ভাবতেই পারেন না।
গৌরাঙ্গের স্ত্রী তনুশ্রী ওরফে মিতার বরাবরের দায়িত্ব দু’দিকের সমর্থকদের জন্য গরম চায়ের জোগান দেওয়া। কাছেই উত্তমকুমারের পাড়ার লোক, ৭২ নম্বর ওয়ার্ডের পুরনো কাউন্সিলর সচ্চিদানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ও বহু বড় ম্যাচে এই বিখ্যাত মোহন-ইস্ট রেষারেষি বা বেরাদরির সাক্ষী থেকেছেন।
পর পর শিলিগুড়ি, বারাসত বা গুয়াহাটিতে ঘটি-বাঙালের যুদ্ধের পরে বেশ কিছু দিন বাদে আবার সল্টলেকে দু’দলের মোলাকাত। ফলে, আমবাঙালির গড়পড়তা আয়েসি রবিবাসরীয় দুপুরের সঙ্গে উত্তাপে খানিক ফারাক মালুম হচ্ছিল বিলক্ষণ। তবে শহর-শহরতলির বিভিন্ন পাড়া থেকে সবুজ-মেরুন কী লাল-হলুদ পতাকা মোড়া ম্যাটাডরগুলো সাঁ সাঁ বেরিয়ে যেতে কিছু ক্ষণের জন্য একটা আপাত ঠান্ডা পরিবেশ। চেতলার প্যারিমোহন রায় রোডে সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবাশিস পাইন বা উত্তর কলকাতায় খন্না সিনেমার কাছে চন্দন সাউ, সোমনাথ সেন, ভিকি সাঁতরাদের সাপ্তাহিক তাসের আড্ডাও মুলতুবি থাকল, বিকেল সাড়ে চারটের ম্যাচের সৌজন্যে।
হোয়াটসঅ্যাপে স্কুলতুতো বন্ধু নিউ ব্যারাকপুরের প্রবাল সমাদ্দার, ফ্রান্সে প্রবাসী সুজয় সরকার, অস্ট্রেলিয়ায় কর্মরত ভাস্কর পাল, রাজ্য সরকারি অফিসার মনোজিৎ মণ্ডল বা গড়িয়ার সঞ্জয় দাসদেরও মিলিয়ে দিয়েছিল চিরকেলে মোহনবাগান এবং ইস্টবেঙ্গল। কোন চ্যানেলে খেলা দেখাচ্ছে রে?— জল্পনার ফাঁকেই ম্যাচের সম্প্রচারের টাটকা ইন্টারনেট লিঙ্কও উড়ে এল বন্ধুদের হাত ঘুরেই।
খেলা দেখার ফাঁকে স্মার্টফোনে আঙুলের ডগায় সরস তরজায় কম যায় না কোনও পক্ষই। মালুম হল, বড় ম্যাচ বা ‘ডার্বি’ যে নামেই ডাকা হোক, কলকাতা আছে কলকাতাতেই।