ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে ‘পাখির চোখ’ করেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। কেননা রাজ্যে বড় শিল্পের সম্ভাবনা কম। গত সাড়ে ছ’বছরে তৃণমূল সরকারের অভিজ্ঞতা হল, এই সময়ের মধ্যে শিল্প ক্ষেত্রে যত কর্মসংস্থান হয়েছে, তার বেশির ভাগটাই মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পে।
অথচ নোট বাতিলের ধাক্কায় সেই ছোট শিল্পই পাহাড়প্রমাণ লোকসানের সম্মুখীন। কী ভাবে হঠাৎ-ক্ষতির এই গন্ধমাদন ঘাড়ে চেপেছে, এক গুচ্ছ তথ্য দিয়ে তার রিপোর্ট কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদের হাতে তুলে দিল নবান্ন। সেই রিপোর্টের দাবি, নোট-নাকচের জেরে রাজ্যে মাঝারি ও ক্ষুদ্রশিল্পে গড়ে ৩০ শতাংশ ব্যবসা কম হয়েছে।
কেন্দ্রীয় সরকারের তিন জনের একটি প্রতিনিধিদল সম্প্রতি বিভিন্ন জেলায় ঘুরে রাজ্যের পরিস্থিতি সরেজমিনে খতিয়ে দেখেছে। নবান্নের তরফে রিপোর্ট তুলে দেওয়া হয়েছে তাদের হাতেই। তাতে বলা হয়েছে: ক্ষুদ্র, মাঝারি শিল্প এবং বস্ত্র দফতরের অধীনে তাঁত, চর্ম ও গয়না শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীরা নগদ-লক্ষ্মীর অভাবে কাঁচামাল কিনতে পারছেন না। ফলে মোক্ষম মার খাচ্ছে উৎপাদন। সেই সঙ্গে বেচাকেনাও বন্ধ বললেই চলে। এক ধাক্কায় প্রায় পাঁচ লক্ষ লোক কাজ হারাতে বসেছেন।
ওই দফতরের এক কর্তা বলেন, ‘‘ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে প্রতিদিন কাজের শেষে মজুরি মিটিয়ে দেওয়াটাই রেওয়াজ। কিন্তু মালিক পক্ষ ব্যাঙ্ক থেকে প্রয়োজনীয় টাকা তুলতে পারছেন না। তাই শ্রমিকদের বসিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। নিজেদের অসহায়তার কথা জানিয়ে আমাদের স্মারকলিপি দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু আমরাই বা কী করতে পারি!’’
নবান্নের তথ্য বলছে, পাঁচশো আর হাজার টাকার পুরনো নোট বাতিলের জেরে প্রায় সাত লক্ষ তন্তুবায় ও পাঁচ লক্ষ শিল্পী সমস্যায় পড়েছেন। নগদ টাকার অভাবে সমবায় সমিতিগুলি সুতো ও রং কিনতে পারছে না। মহাজনের ঘরেও টাকা নেই। তাই সেখান থেকেও খুব বেশি ঋণ মিলছে না। নদিয়ার শান্তিপুর কুঠিরপাড়া সমবায় সমিতির ম্যানেজার স্বদেশ প্রামাণিক জানাচ্ছেন, তাঁরা তন্তুবায়দের সুতো কিনে দেন। তা দিয়ে শাড়ি বোনেন তন্তুজীবীরা। ওঁদের মজুরি দিতে সপ্তাহে এক লক্ষ টাকা লাগে। ‘‘কিন্তু ব্যাঙ্ক থেকে রোজ পাচ্ছি মাত্র ১০-১২ হাজার টাকা। এই অবস্থায় মজুরি না-পেলে তন্তুবায়েরা আমাদের শাড়ি দেবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। সস্তায় খোলা বাজারে ওঁরা সেই সব শাড়ি বেচে দেবেন। তা হলে আমাদের ব্যবসা চলবে কী করে,’’ প্রশ্ন স্বদেশবাবুর। কলকাতার বড়বাজারে কাপড় জোগান দেন ফুলিয়ার কাপড় ব্যবসায়ী মনোজ পাত্র। ‘‘কিন্তু মহাজনেরা কাঁচা টাকা দিতে চাইছেন না। তাই বরাত পাওয়া সত্ত্বেও ব্যবসা গুটিয়ে বসে আছি,’’ মনোজবাবুর গলায় হতাশা।
একই হাল গয়না শিল্পে। কেন্দ্রকে দেওয়া রিপোর্টে রাজ্য বলেছে, এ রাজ্যের গয়না-কারিগরেরা গোটা দেশে ছড়িয়ে আছেন। সংখ্যাটা তিন লক্ষের মতো। নোট-নাকচের ধাক্কায় অনেক সোনার দোকান তালা ঝুলিয়ে দেওয়ায় তাঁরা কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। হাওড়ার আমতা, ডোমজুড়, জয়পুর, উলুবেড়িয়া থেকে তরুণেরা দলে দলে ভিন্ রাজ্যে সোনার কাজ করতে যান। বংশানুক্রমিক ভাবে এটাই তাঁদের একমাত্র রুটি-রুজি। কিন্তু নোটের চোটে কয়েক দিন ধরে ঘরে ফেরার পালা চলছে তাঁদের। এটা তাঁদের অকাল-প্রত্যাবর্তন। এবং তা আদৌ আনন্দের নয়। কারণ কাজ ফেলে এটা মোটেই বাড়ি ফেরার সময় নয়। ‘‘সাধারণত বছরে এক বারই বাড়ি আসি। পুজোর আগে। কিন্তু এখন ফিরলাম হাতে কাজ না-থাকায়। খাইখরচ চালানো যাচ্ছিল না। তাই ফিরে এলাম,’’ বললেন আমতার গড়চুমুকের বাসিন্দা সরোজ ভৌমিক। মুম্বইয়ের জুহুতে একটি সোনার দোকানে কাজ করেন তিনি।
একই ছবি মধ্য কলকাতার হিদারাম ব্যানার্জি লেনে। ওখানে সারি দিয়ে গয়না তৈরির কারখানা। কিন্তু হেমন্তে বিয়ের এই ভরা মরসুমেও বরাত নেই। শ্রমিকদের বসিয়ে বসিয়ে মজুরি দিতে হচ্ছে। তাই অনেকে দোকানের ঝাঁপ ফেলে দিয়েছেন।
নগদ টাকার অভাবে মার খাচ্ছে রাজ্যের চর্মশিল্পও। এই শিল্পের মূল কাঁচামাল পশুচর্ম জোগাড় করতে না-পেরে ধুঁকছে বানতলার শিল্পতালুক। সেখানকার এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘‘মূলত গ্রামীণ এলাকা থেকে ছাগলের চামড়া আসে। সেই চামড়া কিনতে হয় নগদ টাকায়। বাজারে কেনাবেচা কমে যাওয়ায় চর্মশিল্পেও কাঁচামালের চরম টানাটানি।’’ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প দফতরের তথ্য অনুযায়ী চর্মশিল্পের সঙ্গে যুক্ত প্রায় পাঁচ লক্ষ শ্রমিককে সপ্তাহের শেষে নগদে দু’হাজার টাকা করে পারিশ্রমিক দিতে হয়। ওই শ্রমিকদের ৪০ শতাংশই ভিন্ রাজ্য থেকে আসেন এবং তাঁদের অধিকাংশেরই কোনও ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই। এই শিল্পে উৎপাদন মার খাওয়ায় বিদেশে চর্মজ সামগ্রী রফতানিও মার খাচ্ছে বলে কেন্দ্রকে দেওয়া রিপোর্টে জানিয়েছে নবান্ন।