প্রতীকী ছবি।
রাজ্যে গত এক দশকে সামগ্রিক ভাবে প্রসূতি ও শিশু মৃত্যুর হার কমলেও খাস কলকাতার তিন প্রথম সারির মেডিক্যাল কলেজে প্রসূতি মৃত্যুর হার তুলনামূলক ভাবে বেশি।
গত দু’বছরে সরকারি ‘হসপিটাল ম্যানেজমেন্ট ইনফর্মেশন সিস্টেম’ (এইচএমআইসি) এবং হাসপাতালের বার্ষিক রিপোর্ট থেকে এই পরিসংখ্যান সামনে এসেছে। হাসপাতালগুলি হল কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ, এসএসকেএম এবং ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ। এর কোনওটিতে একটি ক্যালেন্ডার বর্ষে (জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর) ৫৯ জন, কোনওটিতে ৩৯ জন প্রসূতি মারা গিয়েছেন।
কেন্দ্রের রিপোর্ট অনুযায়ী, রাজ্যে ২০১৮-১৯ অর্থবর্ষে প্রসূতি মৃত্যুর হার প্রতি লাখ শিশু জন্মে ৮৭ জন। আগে তা ১০৯ জন ছিল। অথচ হাসপাতালের নিজস্ব বার্ষিক রিপোর্ট বলছে, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ বা এসএসকেএমে এক বছরে ১২ বা ১৪ হাজার শিশু জন্মপিছু মারা যাচ্ছেন ৫৯ বা ৩৯ জন। এই রিপোর্টের সঙ্গে এইচএমইসি রিপোর্টের কিছু তারতম্য আছে। তবু এই তিন মেডিক্যাল কলেজে প্রসূতি মৃত্যুর হার দুই রিপোর্টেই তুলনামূলক ভাবে বেশি। এই প্রেক্ষিতে গত ৬ জানুয়ারি সরকারি হাসপাতালগুলির উদ্দেশে এক নির্দেশিকা জারি করে স্বাস্থ্য দফতর জানিয়েছে, প্রসূতি ও শিশু মৃত্যুর হার কমলেও তা প্রত্যাশিত নয়।
আরও পড়ুন: ‘সুভাষচন্দ্রের আজাদি ভুলিয়ে দিচ্ছে বিজেপি’
মেডিক্যাল কলেজগুলিতে চিকিৎসা পরিকাঠামো সবচেয়ে উন্নত বলে ধরা হয়। তা হলে এখানে প্রসূতি মৃত্যু বেশি কেন? হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য অধিকর্তা— প্রত্যেকেই এর জন্য জটিল শারীরিক অবস্থার প্রসূতিকে ‘রেফার’ করে দেওয়ার অভ্যাসকে দায়ী করেছেন।
স্বাস্থ্য অধিকর্তা অজয় চক্রবর্তী বলেন, ‘‘সবাই জানেন এসএসকেএম, মেডিক্যালে ব্যবস্থা অত্যন্ত উন্নত। ফলে যে যেখান থেকে পারছেন খারাপ কেস, জটিল কেস রেফার করছেন। দেখবেন, কলকাতার আরজিকরে বছরে প্রচুর শিশুর ডেলিভারি হয়, কিন্তু প্রসূতিমৃত্যু নেই বললেই চলে। কারণ, ওখানে জেলা থেকে খারাপ কেস অনেক কম রেফার হয়।’’
কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, রেফার হচ্ছে কেন? স্বাস্থ্য পরিকাঠামো শক্তিশালী করতে রাজ্য জুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে মাদার অ্যান্ড চাইল্ড হাব, মাদার ওয়েটিং হাব, আইসিইউ, এসএনসিইউ, নিকু। জেলায় একাধিক নতুন মেডিক্যাল কলেজ তৈরি হয়েছে, স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞকে পাঠানো হয়েছে, সিজারের ব্যবস্থা রয়েছে। সর্বোপরি মা ও শিশুর স্বাস্থ্য পরিষেবার উপর নজর রাখতে বিশেষ টাস্ক ফোর্স রয়েছে। তা হলে সমস্যা হচ্ছে কী করে?
আরও পড়ুন: জন্মকালীন কম ওজন শিশুমৃত্যুর বড় কারণ
স্বাস্থ্য অধিকর্তা বলেন, ‘‘সেটা বুঝতেই এ বার আলাদা করে ‘প্রসূতি রেফার অডিট’ চালু করা হবে। অর্থাৎ কোনও হাসপাতাল কোনও প্রসূতিকে রেফার করলে তার কারণ স্বাস্থ্য ভবনকে জানাতে হবে।’’ প্রসঙ্গত এত দিন শুধু প্রসূতি মৃত্যু ও শিশু মৃত্যুর অডিট করা হত, যাতে মৃত্যুর আসল কারণ জানা যায়।
ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের এক চিকিৎসকের কথায়, ‘‘দক্ষিণ ২৪ পরগনা, সুন্দরবনের দূরবর্তী এলাকা থেকে ফুটো হয়ে যাওয়া জরায়ু, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ নিয়ে প্রসূতিদের ডায়মন্ডহারবারের বদলে আমাদের কাছে রেফার হচ্ছে। দীর্ঘ পথে তাঁদের অবস্থার অবনতি ঘটছে। এখানে ভর্তি হয়েই প্রসূতি মারা যাচ্ছেন। এমনকি এসএসকেএম, এমআর বাঙুর হাসপাতাল থেকেও প্রসূতিদের এখানে রেফার করা হচ্ছে।’’ মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষের তরফে বলা হয়েছে, ‘প্রসূতি বা শিশুর অবস্থা জটিল হলেই লোকে মূলত কলকাতার দু’-তিনটি হাসপাতালে নিয়ে আসে। ফলে সেগুলির উপর চাপ তৈরি হচ্ছে। জেলার ছোটখাটো বহু নার্সিংহোম রোগীর অবস্থা খারাপ হওয়া মাত্র পাঠিয়ে দিচ্ছেন কলকাতায়, তাঁরা ভর্তি হয়েই মারা যাচ্ছেন।’’
এসএসকেএম কর্তৃপক্ষের তরফেও বলা হয়েছে, ‘‘যত প্রসূতি মারা যাচ্ছেন, তাঁদের ৯০ শতাংশ ‘অবস্ট্রাকটিভ লেবার’ নিয়ে প্রত্যন্ত প্রান্ত থেকে রেফার হয়ে কলকাতায় আসছেন। অনেককে হয়তো শয্যার অভাবে ভর্তিও নেওয়া যাচ্ছে না। এখানে পৌঁছতেই তাঁদের অবস্থা এত খারাপ হচ্ছে যে ভর্তি হয়েও অনেকে দু’-তিন ঘণ্টার মধ্যে মারা যাচ্ছেন। অনেককে আবার আমরাও রেফার করছি বাধ্য হয়ে। গুরুতর শারীরিক অবস্থায় ঘুরতে ঘুরতে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে বা সেপসিস হয়ে প্রসূতি মারা যাচ্ছেন।’’