—ফাইল চিত্র।
আরও একটি লেপার্ডের মৃত্যু হল ডুয়ার্সে। পথ দুর্ঘটনায় মারাত্মক জখম হয় সে। ফালাকাটার কাছে তাসাটি চা বাগানের সামনে জাতীয় সড়কের উপর কোনও অজ্ঞাত যানের ধাক্কায় এই চিতাবাঘিনী কোমরে ও মাথায় আঘাত পায়। খবরে প্রকাশ, ২০১৭ থেকে এ পর্যন্ত গাড়ির ধাক্কায় ডুয়ার্সে তিনটি লেপার্ডের মৃত্যু হল। তার আগের বছর যায় দুটি।
এক চিতাবাঘিনীর করুণ মৃত্যুতে আপাতচক্ষে কারও কোনও ক্ষতি হয়নি। সে যখন ভগ্ন কোমর নিয়ে রাস্তায় পড়ে ছিল, তার উঠে দাঁড়াবার ব্যাকুল অসহায় প্রয়াস ক্যামেরাবন্দি করছিলেন অনেকেই। দারুণ আহত বাঘিনীর তখন আক্রমণের ক্ষমতা ছিল না। ফলে, কয়েক হাত দূরত্বে বন্যজন্তুর ছবি তোলার সুযোগ কেউ হারাতে চাননি। কিছুক্ষণের মধ্যে বৈদ্যুতিন সামাজিক মাধ্যমে ছবিটি প্রচারিত হয়ে যায়। দেখা যায়, জখম লেপার্ড অনেক কষ্টে নিজেকে হিঁচড়ে, জঙ্গলে, লোকচক্ষুর আড়ালে নিয়ে যাচ্ছে। বন দফতরের আত্যন্তিক প্রয়াস সত্ত্বেও তাকে শেষ পর্যন্ত বাঁচানো যায়নি।
এ বছরই, ঠিক এভাবেই, মহারাষ্ট্রের ৬ নং জাতীয় সড়কে মারা গেল বৃহৎ পুরুষব্যাঘ্র বাজিরাও। বোর ও মেলঘাট ব্যাঘ্রসংরক্ষণ অরণ্য এলাকার মাঝখান দিয়ে গিয়েছে এই সড়ক। এ কেমন পরস্পর বিরোধিতা? সংরক্ষণ প্রকল্পের মধ্যেই পথ-দুর্ঘটনার অবাধ সম্ভাবনা!
বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে এই বৈপরীত্য শুধু একটি নয়। আরও আছে। বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য, বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ, অরণ্য ও পরিবেশ রক্ষার জন্য অর্থ বরাদ্দ আছে। প্রচার, প্রসার, বিজ্ঞাপন আছে। কিন্তু রেল বা সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত প্রাণীর প্রকৃত সংখ্যা নির্ণয়ের পরিকাঠামো নেই। ভারতে সড়ক নির্মাণ যোজনা ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। আগামী পাঁচ বছরে ভারত সরকার ৮৩,০০০ কিমি পথ নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে। এর অনেকাংশ অরণ্য এলাকার মধ্যে দিয়ে যাবে। সেখানে বাঘ, হাতি, বাইসন বা অন্যান্য প্রাণীর চলপথের সুরক্ষা পরিকল্পনা নেই। অরণ্যের ভিতর দিয়ে প্রসারিত সড়কে কোথাও কোথাও যানের গতি ধীর করার নির্দেশ থাকে, কিন্তু গতিবিধি নিয়ন্ত্রণের পরিকাঠামো নেই। যে-দেশে নিষেধ সত্ত্বেও হাসপাতালের সামনে কান-ফাটানো হর্ন বাজে, উৎসবের বোমাবাজি ফাটানো হয়, সে-দেশে বন্যজন্তুর জন্য যানের গতি ধীর করার সৎ প্রয়াস সকলের কাছে প্রত্যাশিত নয়।
বন্যপশুরা একটি নির্দিষ্ট অলিন্দের মধ্যে দিয়ে বনান্তরে যায় বা নদী ও সড়ক পারাপার করে। জাতীয় সড়ক বা ভারী যানচলাচলের অন্যান্য সড়কগুলি তৈরির সময় বন্যপশুর চলপথ চিহ্নিত করে বিকল্প নির্মাণের কথা ভাবা হয়নি। শহরে মানুষের পারাপারের জন্য ভূগর্ভপথ আছে, সেতুপথ আছে, অঞ্চল বিশেষে যানের গতি নিয়ন্ত্রক নির্দেশ আছে। গতি নির্দিষ্ট মান লঙ্ঘন করলে লুকনো ক্যামেরায় ছবি তুলে, শাস্তিমাশুল ধার্য্য করা আছে, কিন্তু পরিবেশবান্ধব বন্যপ্রাণ ও অরণ্য বড়ই বঞ্চিত। এর জন্য দায়ী সীমাহীন অসচেতনতা। যার অন্তর্গত, যে কোনও শ্রেণির সাধারণ মানুষ। শিক্ষিত বা অশিক্ষিত।
একটি তথ্যসূত্র বলছে, পথ দুর্ঘটনায় গত ৫ বছরে ১৬টি বাঘ মারা গিয়েছে, গত ৮ বছরে ১৫০টি হাতি। ২০১২-’১৭ বর্ষকালে, যত বন্যপ্রাণী পথ দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছে, তার মধ্যে ৩৮ শতাংশ লেপার্ড, যাকে মুখের কথায় চিতাবাঘ বলা হয়। জয়পুরের ঝালানা সংরক্ষিত অরণ্যে চিতাবাঘের সংখ্যা বাড়ানোর প্রয়াস যথেষ্ট সাফল্য লাভ করেছে। কিন্তু সচেতনতার অভাবে সংরক্ষণ ও ধ্বংস একই সঙ্গে ক্রিয়াশীল। সেই সঙ্গে, দূষণজনিত রোগে পশুপক্ষীর মৃত্যু, মানুষের লোভের কারণে বন্যপ্রাণ হত্যা— মৃতের সংখ্যা দ্বিগুণ বাড়িয়ে তোলে।
বাঘ, সিংহ, হাতি, গন্ডার প্রভৃতি বৃহদাকার প্রাণীর দুর্ঘটনা তবু খবর হয়ে ওঠে, কিন্তু ছোটখাটো প্রাণী, জন্তু, সাপ, পাখি, প্রজাপতির নিয়ত অপমৃত্যু আদৌ গ্রাহ্য হয় না। অথচ, তাদেরও আছে প্রাণের অধিকার। তারাও প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও পরিবেশ রক্ষায়, তথা মানবজাতির স্থায়িত্ব রক্ষার জন্য বড়ই গুরুত্বপূর্ণ।
বন্যপ্রাণ নিয়ে কর্মরত কর্মীরা বলছেন, সড়ক দুর্ঘটনার এই তথ্য নির্ভুল নয়, বরং আশঙ্কাজনকভাবে সংখ্যাটি আরও বেশি। জীববিজ্ঞানীরা বলছেন, সমস্যা ব্যাপক, ক্ষতি অপূরণীয়। আজ বিশ্ব জুড়ে এ প্রশ্ন উঠছে, মানবসভ্যতার উন্নতিকল্পে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এই অগ্রগতি কি সত্যিই কল্যাণকর?
যানবাহন শুধু দুর্ঘটনাই ঘটায় না, দূষণও বৃদ্ধি করে। সহজ জীবনযাপনের অত্যাবশ্যক উপাদান প্লাস্টিক বর্জ্য ভয়ানক বিপর্যয় ডেকে আনছে। মাত্র চার মাস আগে, তাইল্যান্ড-মালয়েশিয়া সীমানায় একটি পাইলট তিমি শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যায়। তার পেটে ৮০টি প্লাস্টিক মিলেছে, যার ওজন মোটের উপর ৮ কেজি।
সম্প্রতি কেরলে বিধ্বংসী বন্যার অন্যতম কারণ প্লাস্টিক আটকে নিকাশি ব্যবস্থার অকার্যকারিতা! শিক্ষিত বা শিক্ষা-বঞ্চিত নির্বিশেষে অবিলম্বে পরিবেশ, অরণ্য ও বন্যপ্রাণ বিষয়ে সার্বিক সচেতনতার উদ্যোগ প্রয়োজন। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বারবার সতর্ক করছেন। বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান এবং কয়েকজন ব্যক্তি সাধ্যাতিরিক্ত প্রচেষ্টায় পরিবেশ রক্ষায় উদ্যোগী, তবে প্রয়োজনের তুলনায় তা অত্যল্প। এ ধরনের ব্যাপক জ্ঞাতব্য বিষয়ের প্রচারে সবচেয়ে বড় ও সদর্থক ভূমিকা নিতে হবে ভারত সরকার এবং রাজ্য সরকারগুলিকে।
শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। যে শিক্ষা প্রকৃতি চেনায় না, ঐতিহ্য ও আদর্শ জানায় না, কেবল স্বার্থপর মেধাচর্চা করায়, তাতে মঙ্গল নেই। আমাদের মধ্যে অধিকাংশ জনের ধারণা— মানুষ খেতে-পরতে পাচ্ছে না, হাতি-বাঘ নিয়ে যত আদিখ্যেতা! চিন্তার জগতে এই ভ্রান্তি বড়ই সর্বনেশে। প্রাণীজাগতিক ভারসাম্য রক্ষার তত্ত্বটি তাই সকলকে বোঝানো দরকার।
ভোটের প্রচারে রাজনৈতিক দলগুলি যত অর্থব্যয় করে, তার ১০ শতাংশ অর্থে পরিবেশ সচেতনতার বহুল প্রচার করা যায়। এবং তা করা আশু কর্তব্য। নইলে অচিরে যে কোনও রাজ্যেই কেরলের পুনরাবৃত্তি হবে। দ্রুত গলে যাচ্ছে পৃথিবীর হিমবাহগুলি। দ্রুত বেড়ে উঠছে সমুদ্রতল। প্রকৃতি কাউকে পরোয়া করে না, ক্ষমা করে না। সামূহিক ধ্বংস থেকে আমরা খুব বেশি দূরে নেই আর। (তথ্যসূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা, স্যাংকচুয়ারি এশিয়া পত্রিকা)
(লেখক বিশিষ্ট সাহিত্যিক। মতামত লেখকের নিজস্ব)