বামফ্রন্ট সরকার অস্ত গেলেও রাজ্য সিপিএমে সূর্যোদয় এক প্রকার নিশ্চিত।
পশ্চিমবঙ্গে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক পদ থেকে সরতেই হচ্ছে বর্ষীয়ান বিমান বসুকে। দলের শীর্ষ নেতৃত্বের সিদ্ধান্ত, পলিটব্যুরো সদস্য সূর্যকান্ত মিশ্রই তাঁর স্থলাভিষিক্ত হবেন। নেতৃত্বের কাছে বিমান বসু তাঁর ইস্তফা দেওয়ার ইচ্ছা চূড়ান্ত ভাবে জানিয়ে দেওয়ার পরে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে এই দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু বুদ্ধদেব তাঁদের জানিয়ে দিয়েছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে জেলায় জেলায় সংগঠনকে চাঙ্গা করতে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্তই যোগ্য বিকল্প।
আগামী বছর এপ্রিলে অন্ধ্রপ্রদেশের বিশাখাপত্তনমে পার্টি কংগ্রেস হচ্ছে। তার আগে রাজ্য কমিটিগুলির সম্মেলন হবে। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সম্মেলন হওয়ার কথা। সব ঠিক থাকলে সেখানেই নতুন রাজ্য কমিটি সূর্যকান্তকে সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত করবে। পলিটব্যুরোর আর এক সদস্য নিরুপম সেনের ঘনিষ্ঠ, বর্ধমানের নেতা মদন ঘোষও এই পদের দাবিদার ছিলেন। কিন্তু বর্ধমানের নির্বাচনী ফলাফল ও সাংগঠনিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে তাঁর নাম উঠে আসার সম্ভাবনা অনেকটাই ক্ষীণ। বর্ধমানের আর এক শক্তিশালী নেতা নিরুপম সেন এখনও সুস্থ নন। তিনি এখন মাঝেমধ্যে হুইল চেয়ারে করে আলিমুদ্দিনে আসেন। আলোচনায় অংশও নেন। কিন্তু দৈনন্দিন কাজকর্মের চাপ নেওয়া যে তাঁর পক্ষে মুশকিল, কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তা বুঝেছেন।
পশ্চিমবঙ্গে ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে দলকে নতুন ভাবে হাজির করার কাজ কিন্তু ভিতরে ভিতরে শুরু করে দিয়েছেন প্রকাশ কারাট-বিমান বসু। সর্বশেষ কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি নিয়ে সবিস্তার আলোচনা হয়েছে। সিপিএমের পলিটব্যুরো নেতা সীতারাম ইয়েচুরি বলেন, “পশ্চিমবঙ্গে শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের উপর থেকে মানুষ দ্রুত আস্থা হারাচ্ছেন। মানুষের মধ্যে মোহভঙ্গের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। তিন বছরে তৃণমূল কংগ্রেসের কাজকর্ম নিয়ে শুধু শহর নয়, গ্রামের মানুষও ক্ষুব্ধ।” ইয়েচুরির মতে, এই পরিস্থিতিতে সিপিএমই তৃণমূলের বিকল্প হতে পারে। সেটা হওয়ার জন্য সিপিএমকে খোলনলচে বদলে, নব কলেবরে হাজির হতে হবে।
‘নতুন সিপিএম’ তৈরি করতে গেলে প্রথমে চ্যালেঞ্জ হল নেতৃত্বের পরিবর্তন ও সাংগঠনিক রদবদল। জ্যোতি বসু-হরকিষেণ সিংহ সুরজিতের নেতৃত্ব প্রকাশ কারাট, সীতারাম ইয়েচুরি, বিমান বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও অনিল বিশ্বাসকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে নিয়ে এসেছিলেন। তার পর ধাপে ধাপে তাঁরা পলিটব্যুরোতে আসেন। নবীন প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে ঋ
তব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়কে এখন রাজ্যসভার সদস্য করা হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হল রাজ্য সম্পাদক হিসেবে গ্রহণযোগ্য কোনও নতুন তরুণ নেতাকে বিমান বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যরা তৈরি করে উঠতে পারেননি।
তবে রাজ্য সম্মেলনের আগে জেলা কমিটিগুলির যে সম্মেলন হবে, সেখানে নতুন ও উদ্যমী মুখকে নতুন কমিটিতে আনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। দলীয় সূত্রের খবর, অন্তত ৭টি জেলায় এ বার নতুন সম্পাদক দায়িত্ব নিতে চলেছেন। কলকাতা জেলার সম্পাদক হিসেবে উঠে আসছে বলিয়ে-কইয়ে মানব মুখোপাধ্যায়ের নাম।
তবে শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, মোট ১২টি রাজ্যের সম্পাদক বদলের কথা ভেবেছেন সিপিএমের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী বিশেষ কারণ ছাড়া কোনও ব্যক্তি তিন বার পর্যন্তই কোনও উচ্চতর কমিটির সম্পাদক থাকতে পারেন। ১১টি রাজ্যের সম্পাদকের তিন বারের মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছে। বিমান বসুর এটা দ্বিতীয় দফা চলছে। কিন্তু একের পর এক নির্বাচনী বিপর্যয়ের পরে তিনি আর এই পদে থাকতে চাইছেন না। রাজ্য কমিটির মধ্যেও সম্পাদক হিসেবে নতুন মুখ তুলে আনার দাবি উঠে আসছে।
তিন বারের মেয়াদ শেষ হওয়ায় প্রকাশ কারাটেরও এ বার সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে সরে যাওয়ার কথা। নতুন সম্পাদক হিসেবে কেরলের এস আর পিল্লাই ও অন্ধ্রের বি ভি রাঘবুলুর নাম উঠে আসছে। তবে সীতারাম ইয়েচুরির সাধারণ সম্পাদক হওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ কেন্দ্রীয় কমিটিতে ইয়েচুরির পক্ষে পর্যাপ্ত সমর্থন নেই। এই পরিস্থিতিতে বিকল্প নাম নিয়ে ঐকমত্য না হলে প্রকাশ কারাটকেই আরও একটি মেয়াদ রেখে দেওয়ার চেষ্টা হতে পারে। সিপিএমের একটি সূত্র বলছে, এক সঙ্গে ১২টি রাজ্যে সম্পাদক বদলের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও বদল হলে সমস্যা হতে পারে। দলীয় গঠনতন্ত্রে বিশেষ পরিস্থিতিতে কোনও নেতাকে চতুর্থ দফার জন্য সাধারণ সম্পাদক রাখার পথ খোলা আছে। কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যরা ভোটাভুটিতে এ সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
দলের সাবেকি প্রচারের ধারা যে বদলানো দরকার, প্রকাশ কারাট এখন বুঝছেন। কেন্দ্রীয় কমিটির মুখপত্রে নিজের নিবন্ধে কারাট নিজেই সে কথা বলেছেন। মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে পেটি বুর্জোয়া বলে সরিয়ে রাখার দিন শেষ। লোকসভা নির্বাচনের পর কেন্দ্রীয় কমিটির প্রস্তাবেও বলা হয়েছে, কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণির পাশাপাশি দলকে মধ্যবিত্ত সমাজেরও প্রিয় হয়ে উঠতে হবে। এই রণকৌশল ঠিক করার জন্য এ কে গোপালন ভবন তিনটি কমিটি তৈরি করেছে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, জনসংখ্যার অর্ধেক মানুষের বয়স তিরিশের নীচে। তাঁরা কর্মসংস্থান চাইছেন, শিল্প চাইছেন। সিপিএম উদার অর্থনীতির বিরোধিতা করতে গিয়ে কর্মসংস্থানেরও বিরোধিতা করছে বিশেষ করে মধ্যবিত্তের মধ্যে এমন একটা ধারণা তৈরি হয়েছে। প্রকাশ কারাটরা তাই আলিমুদ্দিনকে বলছেন, গাজায় ইজরায়েলি আগ্রাসনের প্রতিবাদের পাশাপাশি এখন রাজ্যে মূল্যবৃদ্ধি, আলু-সঙ্কট ও ট্যাক্সি ধর্মঘট নিয়েও আন্দোলন জোরদার করতে হবে। অগ্রাধিকার বদলাতে হবে। দলের অনেকে বলছেন, প্রাক্তন রাজ্য সম্পাদক অনিল বিশ্বাসের আমলে জেলায় জেলায় সিপিএমের ক্যাডার বাহিনীর যে আধিপত্য ও দলতন্ত্র তৈরি হয়েছিল, এখন শাসক তৃণমূলের বিরুদ্ধেও সেই অভিযোগই উঠছে। এই পরিস্থিতিতে সিপিএম অতীতে নিজেদের ভুলভ্রান্তিকে স্বীকার না করলে মানুষের পক্ষেও তাদের ‘নতুন সিপিএম’ বলে গ্রহণ করা মুশকিল।
সিপিএমের এক শীর্ষ নেতা বলেন, “আমেরিকার কালো হাত ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও ঢের হয়েছে। এখন মমতা সরকারের কাজকর্ম নিয়ে আমাদের আন্দোলনে নামতে হবে।” বিরোধী দলনেতা হিসেবে সূর্যকান্তের সক্রিয়তা নজর কেড়েছে। আশা করা যায়, রাজ্য সম্পাদক হিসেবেও তিনি সক্রিয় হবেন। তবে তেভাগা-তেলঙ্গানা আন্দোলনের ঐতিহ্যবাহী দলকে মধ্যবিত্তের কাছে আরও নিয়ে যাওয়ার জন্য ট্যাক্সি চালকদের সমর্থনে শ্যামল চক্রবর্তী-রাজদেও গোয়ালাদের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন কতটা লাভজনক হয়েছে, তা নিয়ে দলে বিতর্ক রয়েছে। দলের মধ্যে একটা মত, ট্যাক্সি চালকরা সংখ্যায় কম। কিন্তু ভোগান্তির শিকার মধ্যবিত্ত মানুষ সংখ্যায় অনেক বেশি।
আর একটি বিষয় নিয়েও দলের মধ্যে বিতর্ক চলছে। সিপিএম সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তৃণমূল-বিরোধী শক্তিকে এককাট্টা করতে হবে। সিপিএমকে হঠাতে ঠিক এই কাজটাই করেছিলেন মমতা। এখন এই কাজের জন্য সিপিআই(এমএল)-এর মতো দলকেও সঙ্গে নিতে চায় সিপিএম। কিন্তু এ নিয়েও পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত রয়েছে রাজ্য সিপিএমের অন্দরে। সিপিআই(এমএল) এখন নিজেরাও পরিবর্তিত। সশস্ত্র সংগ্রামের তত্ত্ব ছেড়ে তারা সংসদীয় রাজনীতিতে এসেছে। তাদের জনভিত্তিও আছে। ভোটের হার যা-ই হোক, চিন্তাবিদদের মধ্যে এই দলের অনেক সমর্থক রয়েছেন। অনেকে বলছে নতুন সিপিআই (এমএল)-কে জোটে নিলে মমতা-বিরোধী আন্দোলন জোরদার হবে।
সিপিএম সূত্র বলছে, তৃণমূলের বিরুদ্ধে বামেদের এখনও যথেষ্ট সমর্থন রয়েছে। লোকসভা নির্বাচনে নানামুখী হাওয়ার মধ্যে আসন হারালেও বামেরা ২৯ শতাংশ ভোট পেয়েছে। যার মধ্যে সিপিএম একাই পেয়েছে ২২ শতাংশ ভোট। এই সঙ্কটের মধ্যেও ব্রিগেডে ভাল জনসমাবেশ করতে পেরেছে সিপিএম। বিজেপি এখন রাজ্যে সিপিএমের বিকল্প হিসেবে উঠে আসার চেষ্টা করছে। কিন্তু সিপিএমের এক নেতার হিসেব সংখ্যালঘু ভোট যদি ২৫-৩০% হয়, ক্ষমতায় আসতে গেলে ৭০ ভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠের ৩৫% ভোট বিজেপিকে একক ভাবে পেতে হবে। এখন বিজেপির ভোট ১৭%। দেড়-দু’বছরের মধ্যে তা দ্বিগুণ করাটা কার্যত অসম্ভব। এটা যে এক মাত্র সিপিএমই পারে, সেটা মানুষের কাছে গিয়ে বোঝানোর জন্য সঠিক নেতৃত্বের দরকার। ওই নেতার কথায়, এটা ঠিক যে মমতা সংখ্যালঘু ভোটকে সুসংহত করেছেন। কিন্তু সেখানেও মোহভঙ্গ হচ্ছে। সেই ভোটে ভাঙন ধরাতেও কেবল সিপিএমই পারে। কারণ রাজ্যে কংগ্রেস কার্যত অপ্রাসঙ্গিক।
সিপিএম নেতৃত্ব তাই আপাতত সূর্যকে সামনে রেখেই নতুন রণকৌশল নিয়ে এগোতে চাইছে। ছায়া মুখ্যমন্ত্রী কে হবেন, এখন তা অনুচ্চারিতই থাকছে। দলকে কিছুটা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরে সেটা ঠিক করা হবে।
তবে দলের অনেকেই মনে করছেন, নতুন রণকৌশলে এই সঙ্কটের দিনে রাজ্য নেতৃত্বের উপর নিয়ন্ত্রণ রক্ষায় সেই প্রকাশ কারাটই আরও ক্ষমতাশালী হয়ে উঠবেন।