লোকসভা ভোটে হলদিয়া বিধানসভা এলাকায় প্রাপ্ত ভোট ৪২%। রাজ্যের সব ক’টি বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে বামেদের প্রাপ্ত সর্বোচ্চ ভোট। লক্ষ্মণ-তমালিকা শেঠদের সেই খাস তালুকের জোনাল কমিটি থেকেই আবার এক ধাক্কায় ৩৯ জনের ইস্তফা!
এমনই বৈপরীত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পূর্ব মেদিনীপুরের সিপিএম! তৃণমূলের ‘সন্ত্রাস’ এবং দলের মধ্যেই প্রবল গোষ্ঠী-বিবাদ সামলে লোকসভা ভোটে যা ফল হয়েছে, সেই ইতিহাস মাথায় রেখে আপাতত সতর্ক পদক্ষেপ করতে চাইছে তারা। যে কারণে তাদের সিদ্ধান্ত, পদত্যাগীদের সঙ্গে কথা বলে যাচাই করা হবে তাঁদের ‘বিদ্রোহ’ কতটা আসল!
লক্ষ্মণ-জায়া তমালিকা-সহ সিপিএমের পূর্ব মেদিনীপুর জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর ৬ জন সদস্য দল ছাড়ার ঘোষণা করেছেন শনিবার। তাঁদের মধ্যে ৩ জনের বিরুদ্ধে অবশ্য আগেই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছিলেন দলীয় নেতৃত্ব। সিপিএম সূত্রের বক্তব্য, সব মিলিয়ে তাঁরা ৬১ জনের দল ছাড়ার চিঠি হাতে পেয়েছেন। তার মধ্যে জেলা কমিটির সদস্য ২১ জন। যাঁরা দল ছাড়ার চিঠিতে সই করেছেন, তাঁদের সবাই আবার তমালিকাদের ঘোষণার সময় উপস্থিত ছিলেন না। তমলুকে যখন এই ভাঙন-পর্ব চলছে, তখনই দলের জেলা দফতরে বৈঠকে হাজির ছিলেন সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য সূর্যকান্ত মিশ্র এবং রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর তরফে জেলার ভারপ্রাপ্ত নেতা রবীন দেব। জেলা নেতৃত্বকে সূর্যবাবুরা পরামর্শ দিয়েছেন, পদত্যাগীদের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তাঁদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করতে হবে।
সিপিএমে পদত্যাগ স্বীকার করার কোনও রেওয়াজ নেই। কেউ চাইলে দলীয় সদস্যপদ নবীকরণ না করিয়ে সম্পর্কে ইতি টানতে পারেন। কিন্তু ইস্তফার কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা করলে পত্রপাঠ তাঁকে বহিষ্কার করা হয়। দু’বছর আগে ঠিক যেমন করা হয়েছিল দিল্লিতে সিপিএমের গবেষণা শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা প্রসেনজিৎ বসুর ক্ষেত্রে। কিন্তু পূর্ব মেদিনীপুরে অত দ্রুত কোনও পদক্ষেপ হচ্ছে না। দলের এক জেলা নেতার কথায়, “যাঁরা দল ছাড়ার ঘোষণা করেছেন, তাঁদের অনেকের বিরুদ্ধেই তদন্ত চলছিল। দল শাস্তি দেবে বুঝে তাঁরা আগেই ছেড়ে দেওয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু সকলের বিরুদ্ধেই যে অভিযোগ ছিল, এমন নয়। কেন তাঁরা দলত্যাগ করলেন, চিঠিতে তাঁরা নিজেরাই সই করেছেন কি না, এ সবই কথা বলে দেখা হবে।” তমালিকা বা অমিয় সাহুদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা হবে বলে অবশ্য সিপিএম সূত্রে ইঙ্গিত নেই। কারণ, তাঁরা প্রকাশ্যেই দলের রাজ্য নেতৃত্বের বিরুদ্ধে তোপ দেগে যা বলার ছিল, বলেই দিয়েছেন!
সিপিএম সূত্রে যে ৬১ জনের দল ছাড়ার চিঠি পাওয়ার কথা বলা হচ্ছে, তাঁদের মধ্যে ৩৯ জনই হলদিয়া থেকে! হলদিয়া জোনালের আওতায় সিপিএমের সদস্যসংখ্যা ২৩০০। এই হলদিয়া বিধানসভা এলাকাতেই আবার লোকসভায় ৪২% ভোট পেয়েছে সিপিএম। দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের বক্তব্য, “হলদিয়া পুরসভায় জেতার সময় লক্ষ্মণ-তমালিকার কৃতিত্ব। আর সেই পুুরসভা হাতছাড়া হওয়ার সময় সিপিএমের ব্যর্থতা! এই ধরনের যুক্তি নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে আমরা বরং এখন নজর দিতে চাই পার্টির সেই লোকজনের দিকে, যাঁরা স্থানীয় স্তরে নীরবে কাজ করে যাচ্ছেন।”
পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় এ বার লোকসভায় ৪১% ভোট পেয়েছে সিপিএম। ভোটপ্রাপ্তির নিরিখে সিপিএমের কাছে এক নম্বর জেলা। রায়গঞ্জে মহম্মদ সেলিম বা মুর্শিদাবাদে বদরুদ্দোজা খান যত ভোট পেয়ে জিতেছেন, কাঁথির সিপিএম প্রার্থী তাপস সিংহ তার চেয়ে লক্ষাধিক ভোট বেশি পেয়েছেন। লক্ষ্মণকে বহিষ্কারের পরে তাঁর অনুগামীদের সহযোগিতা নির্বাচনী লড়াইয়ে বিশেষ পাওয়া যাবে না জেনেও তমালিকাদের নির্দিষ্ট দায়িত্ব দিয়েছিল সিপিএম। এবং তার ফলেই বিক্ষুব্ধদের অসহযোগিতা ধরে ফেলতে তাঁদের সুবিধা হয়েছে বলে সিপিএম নেতৃত্বের দাবি। রবীনবাবুর কথায়, “যাঁরা এখন বিরাট বিবৃতি দিচ্ছেন, তাঁদের সকলে ভোটের সময় ঠিকমতো কাজই করেননি! তা সত্ত্বেও দু’জন নতুন প্রার্থী দিয়ে তমলুক ও কাঁথিতে আমরা ভাল ভোট পেয়েছি। প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও জেলায় বেশ কিছু কর্মসূচি হয়েছে।”
দলত্যাগীদের সঙ্গে সিপিএম নেতৃত্বের চাপানউতোর অবশ্য স্বাভাবিক ভাবেই অব্যাহত। বহিষ্কৃত প্রাক্তন সাংসদ লক্ষ্মণবাবু যেমন বলেছেন, “সেই ২০০৭-এর ৩ জানুয়ারি থেকে (যে দিন নন্দীগ্রামের ভুতার মোড়ে গুলি চলেছিল) রাজ্যের ‘ডি ফ্যাক্টো’ মুখ্যমন্ত্রীর নাম তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ছিলেন ‘ডি জুরি’ (আইনগত ভাবে, কাগজে-কলমে) মুখ্যমন্ত্রী। আমাদের লোকজন আক্রান্ত হয়েছে, ঘরছাড়া হয়েছে। বাম সরকার থেকেও কোনও লাভ হয়নি। পরে আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা হয়েছে। প্রশাসনিক ভাবে সম্পূর্ণ ব্যর্থ সেই বুদ্ধবাবুই এখনও দলের পদ অলঙ্কৃত করে বসে আছেন!”
লক্ষ্মণ-তমালিকাদের বিস্তর ক্ষোভ এখন গিয়ে পড়েছে রবীনবাবুর উপরে! লক্ষ্মণবাবু আরও বলছেন, “বিমান বসু, সূর্যকান্ত মিশ্র থেকে তদন্তকারী দলের সদস্য মৃদুল দে, নৃপেন চৌধুরী রাজ্য নেতৃত্বের বহু নেতা বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে যুক্ত। তাঁদেরগুলো জনকল্যাণকামী, আর আমার ‘আইকেয়ার’ই শুধু বাণিজ্যিক!” অভিযোগ উড়িয়ে রবীনবাবুর আবার পাল্টা মন্তব্য, “যে আক্রমণ তৃণমূলের দিক থেকে আসার কথা, তার দায়িত্ব এখন ওঁরা নিয়েছেন! রাজ্য পার্টির তরফে তদন্ত এবং ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব আমার উপরে বলেই এই আক্রমণ আসছে। এতে আমি গর্বিত!”