রাজ্যপাট গিয়েছে। খাজনাতেও টান। সাড়ে তিন দশকের দোর্দণ্ডপ্রতাপ শাসক দলকে এখন তাই আবার দুয়ারে দুয়ারে ফিরতে হচ্ছে চাঁদার রসিদ হাতে!
দলের মোট তহবিলের যা লক্ষ্যমাত্রা, তার ৭০%-ই এখন থেকে পাড়ায় পাড়ায়, বাড়ি বাড়ি গিয়ে আদায় করতে হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে সিপিএমের রাজ্য প্লেনামে। গণসংগ্রহ থেকে যে ৭০% তহবিল আসবে, তার বাইরের ৩০% জোগাড় করতে হবে দলীয় সদস্যদের লেভি থেকে। ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়ার পরে আয়ের উৎস যখন শুকিয়ে গিয়েছে, সেই সময়ে পুরনো পথেই আবার ফিরতে চাইছে আলিমুদ্দিন। লেভি বাকি রাখলে সদস্যপদ বাতিলের কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে, বাড়ি বাড়ি চাঁদা নিতে যাওয়ার কথাও বলতে হচ্ছে।
জনমানসে অবশ্য প্রশ্ন আছে— শাসক দলে থাকার সময়ে ‘অনুদানের সৌজন্যে’ দলীয় কার্যালয়ের নামে পেল্লায় অট্টালিকা গড়ে তুলেছিল যারা, ব্যবসায়ী থেকে শিল্পপতিদের সঙ্গে ওঠাবসা ছিল যে দলের নেতাদের, তারা হঠাৎ বাড়ি এসে হাত পাতবে কেন? আর হাত পাতলেই বা মানুষ হাত উপুড় করবেন কেন? সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের সরস জবাব, ‘‘আমাদের দলে তো এমন কেউ নেই, যাঁর
তিনটে আঁচ়ড় থেকে ১৫ লক্ষ টাকা উঠে আসবে! আমাদের নিজস্ব পদ্ধতিই নিতে হয়। আর তর্কের খাতিরে বলা যায়, রত্নাকরও তো বাল্মীকি হয়েছিল!’’
দুর্দিনে দল চালানোর উপায় বার করতে গিয়ে দৈনন্দিন খরচে ইতিমধ্যেই রাশ টেনেছেন রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র। দলকে ব্যয়সঙ্কোচের বার্তা দিতে নিজে সদলবল দিল্লিতে পলিটব্যুরো বৈঠকে যোগ দিতে গিয়েছেন বিমানের বদলে ট্রেনে চেপে। এখন নতুন লক্ষ্য ব্যাখ্যা করে তিনি বলছেন, ‘‘পার্টির মোট তহবিলের ৭০% পাড়ায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে গণসংগ্রহ করতে হবে। বাড়ি বাড়ি যাওয়া মানে শুধু তো চাঁদা নেওয়া নয়। এতে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ে। গণসংগ্রহ এবং লেভি থেকে যা আসবে, তা থেকেই সর্বক্ষণের কর্মীদের ভাতা এবং আন্দোলন-কর্মসূচির খরচ চালাতে হবে।’’ দলীয় পত্র-পুস্তিকার বিক্রি বাড়িয়েও কিছু আয়ের সংস্থান করতে বলা হয়েছে।
কিন্তু রাজ্য জুড়ে ছড়িয়ে থাকা দলীয় কার্যালয় এই কঠিন সময়ে কেন বাণিজ্যিক ভাবে কাজে লাগাচ্ছে না সিপিএম? জনপ্রিয় ধারণা হল, সেই কাজ করতে পারলে আজকের বাজারে খরচ চালানো নিয়ে ভাবতে হবে না সিপিএমকে! দলীয় সূত্র অবশ্য বলছে, লোকাল কমিটি স্তরে অধিকাংশ কার্যালয় সিপিএমের নিজস্ব সম্পত্তি।
কিন্তু জোনাল থেকে জেলা হয়ে রাজ্য স্তরে কার্যালয় সব কোনও না কোনও অছি পরিষদের দায়িত্বে। দলের পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিমের কথায়, ‘‘বাংলায় কোনও কার্যালয়ই বাণিজ্যিক ভাবে কাজে লাগানোর কথা ভাবা হয়নি এখনও। অন্য রাজ্যে কোথাও কোথাও আছে। অছির সম্পত্তি ভাড়া দেওয়ার ব্যবস্থা করা যাবে না, এমন নয়। কিন্তু তাতে দল সম্পর্কে ভুল বার্তা
যাওয়ার আশঙ্কাও আছে। লোকে তখন বলতে পারে, দ্যাখো সিপিএম ব্যবসা করছে!’’
পরম্পরাগত ভাবে জেলা বা জোনাল স্তরে কিছু কার্যালয়ের নীচে দোকানপাট আছে। আর এখন তৃণমূলের হাতে পর্যুদস্ত হওয়ার পরে দুই ২৪ পরগনা, বর্ধমান বা কোচবিহারের মতো বেশ কিছু জেলার সিপিএম কার্যালয় বা
হুগলিতে বহু জোনাল দফতর ঘরছাড়া বাম কর্মী-সমর্থকদের আস্তানা। তাদের তুলে দিয়ে আয় বাড়াতে বিয়েবাড়ির মতো কাজে কার্যালয় ভাড়া দেওয়ার মতো ‘বিপ্লব’ এখনও করতে পারেনি সিপিএম! সেলিম বলছেন, ‘‘ওই ভাবে আয়
বাড়ানোর দরকার নেই এখন। যা আয় হবে, সেইমতো খরচ করেই
দল চলবে।’’
ঠেকায় পড়ে ইদানীং ব্রিগে়ড সমাবেশে আসার জন্য বিপুল গাড়ি ভাড়া করার বিলাসিতা ছেড়ে বাসে-ট্রেনে সওয়ার হতে শুরু করেছেন সিপিএম কর্মীরা। বাড়ি বাড়ি চাঁদার জন্য হাজির হওয়াও সেই লক্ষ্যে আরও একটু এগোনো।
প্রবীণ নেতা বিমান বসু দলের কর্মীদের পরিষ্কারই বলেছেন, মানুষের কাছে চাঁদা চাইতে যাওয়ার মধ্যে কোনও লজ্জা নেই। পরিস্থিতির ঠ্যালাই সিপিএমকে আবার ফিরিয়ে দিচ্ছে বামপন্থার সাবেক পাঠশালায়!