প্রকাশ কারাট ও তাঁর বাহিনী দিল্লিতে। কলকাতায় বামফ্রন্টের শরিকেরা। এই দুইয়ের জাঁতাকলে পড়ে কংগ্রেসের সঙ্গে জোটরক্ষা করতে জেরবার সিপিএম। মধ্যপন্থা বার করতে যত কৌশলী হতে চাইছে আলিমুদ্দিন, তত বাড়ছে বিভ্রান্তি! বিশেষত, নিচু তলায়।
দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেই বাংলায় কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতার পথে এগিয়েছিলেন সূর্যকান্ত মিশ্র, বিমান বসুরা। ভোটে ভরাডুবির পরেও জোটের সিদ্ধান্তে কোনও ভুল ছিল না বলেই সওয়াল করে গিয়েছেন তাঁরা। কিন্তু বিপর্যয়ের সুযোগে কারাট শিবির আলিমুদ্দিনের কাছ থেকে হিসাব উসুল করতে ছাড়ছে না! কংগ্রেসের হাত ধরার সিদ্ধান্ত দলের লাইনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না, এই মর্মেই নিদান দিয়েছে সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটি। আবার ভোটে আসন খুইয়ে বাম শরিকেরাও কংগ্রেস-প্রশ্নে সিপিএমের উপরে খড়গহস্ত। এক দিকে কেন্দ্রীয় কমিটি এবং অন্য দিকে শরিক নেতৃত্বের মান রাখতে দু’কূল বজায় রেখে এগোতে চাইছেন সূর্যবাবুরা। তাতে কোনও কূলই প্রায় রক্ষা হচ্ছে না!
পরিষদীয় দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে কংগ্রেসের মিছিলে যাওয়ায় উত্তর দমদমের বিধায়ক তন্ময় ভট্টাচার্যকে প্রকাশ্যে ভর্ৎসনা করেছে সিপিএম। কমিউনিস্ট পার্টিতে শৃঙ্খলার আলাদা গুরুত্ব আছে মেনে নিয়েও দলের মধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে, এর ফলে কি জোট সম্পর্কে ভুল বার্তা যাচ্ছে না? এবং এই বিভ্রান্তিকর পরিবেশ যত বজায় থাকবে বাম শিবিরে, তত বেশি করে রাজ্যে বিরোধী রাজনীতির পরিসর পুরোপুরি কংগ্রেসের দখলে চলে যাবে বলেও দলের একাংশের আশঙ্কা। সিপিএমের এক বিধায়কের কথায়, ‘‘রাস্তায় নামতে গেলেও এখন কোন মিছিলে কার সঙ্গে যাওয়া যাবে না, এই সব নিয়েই প্রচুর ভাবতে হচ্ছে! এই ভাবে কি আন্দোলন হয়? সাধারণ মানুষ এত সূক্ষ্ম কৌশল নিয়ে ভাবিত হবেন কেন?’’
বিভ্রান্তিতে আরও উপাদান জোগাচ্ছে বিধানসভার অন্দরের ঘটনাপ্রবাহ। সেখানে কিন্তু কংগ্রেস ও বাম পরিষদীয় দল দিব্যি হাতে হাত মিলিয়েই চলছে! দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ে বিধানসভার অধিবেশনে বেসরকারি প্রস্তাব এনে আলোচনা এবং গুরুত্বপূর্ণ নানা দফতরের ব্যয়রাদ্দ নিয়ে বিতর্কের জন্য আরও সময় বাড়ানোর দাবি ছিল বিরোধীদের। বিধানসভার কার্য উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে সোমবার সেই দাবি মানা হয়নি। বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নান তাঁদের প্রতিবাদ নথিভুক্ত করতে চেয়ে সভায় ভোটাভুটি চেয়েছিলেন। স্পিকার রাজি না হওয়ায় মান্নান ও সুজন চক্রবর্তীর নেতৃত্বে কংগ্রেস ও বাম বিধায়কেরা একই সঙ্গে কক্ষত্যাগ করেছেন। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে বাম ও কংগ্রেস একই সঙ্গে প্রতিবাদ করতে পারলে ওই বিষয়েই মিছিলে গিয়ে তন্ময়বাবু কী ভুল করলেন?
সুজনবাবু অবশ্য বোঝাতে চেয়েছেন, তন্ময়বাবুকে ভর্ৎসনার সঙ্গে জোটের কোনও সম্পর্ক নেই। তাঁর বক্তব্য, ‘‘পরিষদীয় দলে আলোচনা করে একটা সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সিদ্ধান্ত না মেনে মিছিলে গিয়ে উনি ঠিক করেননি।’’ একই ভাবে দলের এক পলিটব্যুরো সদস্যেরও ব্যাখ্যা, ‘‘ওই মিছিল নিয়ে বামফ্রন্টের মধ্যে কোনও ভুল বোঝাবুঝি চাইনি। পরিষদীয় দল যখন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেটা না মানা তো শৃঙ্খলাভঙ্গ।’’ রাজ্য সম্পাদক সূর্যবাবুর উপস্থিতিতে এ দিন দলের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা কমিটির বৈঠকে তন্ময়বাবুও মেনে নিয়েছেন, দলের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। এই নিয়ে দলের অভ্যন্তরে ‘ক্ষতিকর চর্চা’ বন্ধ হোক।
ধন্দ ও বিভ্রান্তির আবহের মধ্যে সংঘাতের বাতাবরণও কাটেনি। সূর্যবাবুরা যেমন চাইছেন, বামফ্রন্টকে টিকিয়ে রেখেও নানা প্রশ্নে কংগ্রেসের সঙ্গে রাস্তায় নামা অব্যাহত রাখতে। জেলা কমিটির বৈঠক থেকে বেরিয়ে এ দিন সূর্যবাবু বলেছেন, ‘‘আগামী দিনেও বাম-কংগ্রেস একসঙ্গে নামবে। আগামী ২ সেপ্টেম্বর দেশে সাধারণ ধর্মঘটের সমর্থনে লাল ও তেরঙ্গা ঝান্ডা একসঙ্গেই উড়বে।’’ বৈঠকের অন্দরে তাঁর জোর সওয়াল ছিল জোট-সিদ্ধান্তের পক্ষেই। কারাটেরা আবার চাইছেন জোটের সিদ্ধান্ত ঠিক হয়নি বলে কেন্দ্রীয় কমিটির যে বিশ্লেষণ, তাকে দলের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে। এ কে গোপালন ভবনের এক পলিটব্যুরো সদস্যের বক্তব্য, ‘‘গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নীতি মেনেই কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্ত নিচু তলা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া দরকার। যাতে সব স্তরে তা নিয়ে আলোচনা হয়।’’ ওই নেতার যুক্তি, জোটের দাবি নিচু তলা থেকে এসেছিল বলে যে কথা আলিমুদ্দিন বলেছিল, তা ঠিক ছিল না। কারণ ভোটের পরে বাংলার নেতারাই বলেছেন, জোটের প্রশ্নে গোটা দল ও ফ্রন্ট এক সুরে বাজেনি।
এমতাবস্থায় কেন্দ্রীয় কমিটির নির্দেশিত ‘লাইন সংশোধন’ নিয়ে আলোচনার জন্য ১০ জুলাই কলকাতায় দলের রাজ্য কমিটির বৈঠকে হাজির থাকার কথা অধিকাংশ পলিটব্যুরো সদস্যের। তার আগে একটি অনুষ্ঠানে কাল, বুধবারই শহরে আসছেন সীতারাম ইয়েচুরি। বিভ্রান্তি কাটানোর পথ বার করতে আপাতত দিশাহারা তাঁরা!