ভিড়ে ঠাসা ব্রিগেডে সিপিএমের সমাবেশে বক্তা তখন বিমান বসু। মঞ্চে রয়েছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং প্রকাশ কারাট। রবিবার সুদীপ্ত ভৌমিকের তোলা ছবি।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ছায়াযুদ্ধের হুঙ্কার এ বার নেই। তৃতীয় ফ্রন্ট গড়ে তোলা জাতীয় কোনও অবাস্তব ঘোষণাও নয়! কোণঠাসা পরিস্থিতিতে একেবারে গোড়ার শিক্ষাতেই ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করল সিপিএম। দলের রাজ্য সম্মেলন উপলক্ষে ব্রিগেড সমাবেশ থেকে সিপিএমের কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য নেতারা ডাক দিলেন শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার। পাড়ায় পাড়ায় প্রতিবাদের পাশে দাঁড়ানোর।
লোকসভা ভোট এবং তার পরে কয়েকটি উপনির্বাচনে বামেদের লাগাতার বিপর্যয়ের পরেও ব্রিগেড সমাবেশে রবিবার ভিড় হয়েছিল নজরে পড়ার মতো। সেই ভিড়ের সামনে দলের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট, রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু, পলিটব্যুরোর সদস্য সীতারাম ইয়েচুরি, সাংসদ মহম্মদ সেলিম, বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বা প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সিপিএমের শীর্ষ নেতৃত্বের গলায় মূল সুরই থাকল প্রতিরোধের। তৃণমূলের সরকারকে ‘অসভ্য সরকার, অসৎ সরকার’ বলে কটাক্ষ করে বুদ্ধবাবু যেমন বলেছেন, “ব্রিগেডের ডাক, এই সরকার হঠাও! যে শক্তি দিয়ে এই সরকারকে উৎখাত করা যায়, সেই শক্তি চাই!” তাঁর মন্তব্য, “এই সরকার রাজ্যকে নরককুণ্ড বানিয়েছে! এ নরককুণ্ড চলতে পারে না!” বিমানবাবুও সরাসরি বলেছেন, “এদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।”
ব্যঙ্গচিত্রে মোদী-মমতা। রবিবার ব্রিগেডে সিপিএমের সভায় দেখা গেল এমনই কিছু পোস্টার। নিজস্ব চিত্র
বাম কর্মীরা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে গেলে যে পাল্টা আক্রমণের শিকার হতে পারেন, বিমানবাবুরা তা ভালই জানেন। জেলায় জেলায় স্থানীয় ভিত্তিতে শাসক দলের হাতে যাঁরা ইতিমধ্যে আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁদের পাশে সিপিএমের নেতৃত্ব সময়মতো গিয়ে দাঁড়াননি এই সমালোচনা দলের ভিতরেই আছে। সিপিএম নেতৃত্বের দেওয়া আনুষ্ঠানিক হিসাবে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে ৫০ হাজার বাম কর্মী ঘরছাড়া হয়েছেন। এর পরে আক্রান্তদের পাশে না দাঁড়ালে যে দল ধরে রাখাই মুশকিল হবে, তা বুঝেই রাজ্য সম্মেলন শুরুর মুখে ব্রিগেডের মঞ্চকে বার্তা দেওয়ার জন্য বেছে নিয়েছেন বুদ্ধবাবু, সূর্যবাবুরা। প্রতিরোধের ডাক দিতে গিয়েই চ্যালেঞ্জের ভঙ্গিমায় বিমানবাবু এ দিন বলেছেন, “যা হবে, দেখে নেব। যা হবে, বুঝে নেব!’’ তৃণমূলকে ‘গোদ’ এবং বিজেপি-কে ‘গোদের উপরে বিষ ফোড়া’ বলে উল্লেখ করে বিরোধী দলনেতা সূর্যবাবু বলেছেন, “গোদ আর বিষফোড়া, দু’টোকেই চেঁছে সাফ করতে হবে! সেটাই একমাত্র চিকিৎসা।” পাশাপাশিই দলের কর্মী-সমর্থকদের প্রতি তাঁর আহ্বান, “আপনাদের ঝান্ডার সঙ্গে ডান্ডাগুলোকে আরও শক্ত করুন। শপথ নিন, আগামী পুুরভোটে একটা বুথও দখল করতে দেব না! দরকারে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই করব! এলাকায় ফিরে গিয়ে এই প্রতিজ্ঞাই আপনাদের ছড়িয়ে দিতে হবে।”
রাজ্যে যখন বিজেপি দ্বিতীয় স্থান দখলের জন্য বামেদের সঙ্গে টক্কর দিচ্ছে, তখন সর্বতোভাবেই কর্মীদের বাড়তি মনোবল জোগানোর চেষ্টা চালিয়েছেন সিপিএম নেতারা। সামনে কলকাতা-সহ ৯৩টি পুরসভার ভোট। বছর ঘুরতেই বিধানসভার নির্বাচন। এই প্রেক্ষাপটে এক দিকে তৃণমূলের বিরুদ্ধে ‘প্রতিরোধের ডাক’ দিয়ে প্রধান প্রতিপক্ষ হিসাবে নিজেদের তুলে ধরা, আর এক দিকে মোদী সরকারের প্রবল সমালোচনা এই দ্বিমুখী কৌশলই আগামী দিনে তাঁদের লড়াইয়ের ময়দানে ফিরিয়ে আনতে পারে বলে সিপিএম নেতৃত্ব মনে করছেন। বিশেষত, যে কোনও ধরনের আক্রমণের প্রতিবাদের পাশে দাঁড়ানোর উপরেই বেশি জোর দিয়েছেন তাঁরা। ভোটবাক্সে দলের লাগাতার রক্তপাত আটকাতে এলাকায় এলাকায় নিচু তলার কর্মীদের সঙ্গে নেতাদের একাত্মতাবোধ গড়ে তোলা, গরিব মানুষের জীবন যন্ত্রণার সঙ্গী হওয়া এই সনাতনী পথে যাওয়ার কথাই বলে আসছিলেন কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো বর্ষীয়ান নেতারা। ব্রিগেডে বিমানবাবু, সূর্যবাবুদের কথায় এ দিন যেন সেই পথেরই ইশারাই ধরা পড়েছে।
সিপিএমের জনসমর্থনের পাশাপাশি সদস্য সংখ্যা, সর্বক্ষণের কর্মীসংখ্যাও ক্রমে নিম্নমুখী। রাজ্য সম্মেলনে দলের সাংগঠনিক রিপোর্টেও তা স্বীকার করা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বুদ্ধ-বিমান-সূর্য দুই কেন্দ্রীয় নেতা কারাট, ইয়েচুরি থেকে সমাবেশের মহিলা মুখ রেখা গোস্বামী পর্যন্ত সকলেই বোঝাতে চেষ্টা করেছেন, তাঁরাই তৃণমূলের বিরুদ্ধে প্রধান প্রতিপক্ষ। এ রাজ্যে সংখ্যালঘু মানুষ প্রায় ২৮%। সেই দিকে লক্ষ রেখেই কারাট-ইয়েচুরিদের দাবি, একমাত্র বামপন্থীরাই বিজেপি-কে রুখতে পারে। এ কথা বোঝাতে রাজ্যসভায় কী ভাবে তাঁর আনা সংশোধনীতে মোদী সরকারের পরাজয় হয়েছে, তা-ও উল্লেখ করেন ইয়েচুরি। সেলিম কটাক্ষ করেন, লোকসভা ভোটের আগে নরেন্দ্র মোদীকে কোমরে দড়ি দিয়ে ঘোরানোর কথা বলে সংখ্যালঘুদের মন জয় করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এখন সেই দড়ি তাঁর সঙ্গে আছে তো?
তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্য সিপিএমের ব্রিগেড-বার্তাকে একেবারেই গুরুত্ব দিতে নারাজ। দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বুঝিয়ে দিয়েছেন, সিপিএমকে আর গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই। সেলিমের কটাক্ষের জবাবে মন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিম বলেছেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নরেন্দ্র মোদীর কাছে যাচ্ছেন না। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাচ্ছেন। রাজ্যের স্বার্থে যাচ্ছেন। মমতার বিরোধিতা করতে করতে ওঁরা বাংলা-বিরোধী হয়ে গিয়েছেন! সে জন্যই শেষ হয়ে যাচ্ছেন!” এমনকী, দলে কোণঠাসা হয়ে নানা বিষয়ে তৃণমূলকে খোঁচা দিতে ব্যস্ত মুকুল রায়ও বামেদের কটাক্ষ করে মন্তব্য করেছেন, “সিপিএম ক্ষয়িষ্ণু দল। যত দিন যাচ্ছে, ততই ভারতের রাজনীতিতে তারা ক্ষয়ে যাচ্ছে। আগামী দিনে আরও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে!”
রাজ্যে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে তাদের ১০৬ জন কর্মী খুন হয়েছেন বলে সিপিএমের অভিযোগ। ব্রিগেডের মঞ্চের সামনে শহিদ বেদি নির্মাণ করা হয়েছিল। নিহত সিপিএম কর্মীদের কথা উল্লেখ করে সেলিম এ দিন বলেন, “যাঁরা রক্ত দিয়েছেন, তাঁদের প্রতিটি রক্তবিন্দুর হিসাব আমরা মিলিয়ে নেব!” সেলিমই ছিলেন এ দিন সব চেয়ে আক্রমণাত্মক। টেট থেকে সারদা তৃণমূল সরকারের একের পর এক দুর্নীতির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আগামী দিনে প্রত্যেক ইঞ্চির জন্য আমরা লড়বো। এ বার লড়াই আরও জোরদার হবে। ৩৪ বছর ধরে এত কষ্ট করে রাজ্যটাকে তৈরি করেছিলাম, তা নষ্ট হতে দেব না!”
রাজ্য সম্মেলন উপলক্ষে একক ভাবে সিপিএমের ব্রিগেড সমাবেশ হলেও শরিক দলের নেতৃত্বকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। ফরওয়ার্ড ব্লকের অশোক ঘোষ, সিপিআইয়ের প্রবোধ পণ্ডা, মঞ্জুকুমার মজুমদার, আরএসপি-র মনোজ ভট্টাচার্যরা ছিলেন মঞ্চে। একক শক্তিতে নয়, বাম ঐক্যকে তুলে ধরেই যে আগামী দিনে তৃণমূল-বিজেপি’র বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামতে হবে, সিপিএম নেতৃত্ব তা-ও স্পষ্ট করে দেন। তৃণমূলের পাশাপাশি বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রসঙ্গ তুলে বুদ্ধবাবু বলেন, “কিছু লোক বলছে, বামেরা রামেদের জমি ছেড়ে দিক। রাম মানে নাথুরাম! নাথুরাম গডসেদের কাছে কেন আত্মসমর্পণ করব? সব শক্তি দিয়ে লড়ব। সব বামপন্থীদের ঐক্যবদ্ধ করতে চাই।” সব বামপন্থী দলকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলনের ডাক দিয়ে বিমানবাবুও বলেন, “দুর্নীতি আর মানুষের শত্রুর এই সরকার, আর নেই দরকার!”