রাজ্য সরকারের আপত্তি অগ্রাহ্য করে ১৬ জুনের মধ্যেই সাত পুরসভার বকেয়া নির্বাচন সেরে ফেলার নির্দেশ দিল কলকাতা হাইকোর্ট।
রাজ্য সরকার আদালতে আবেদন জানিয়ে বলেছিল, পুরসভার সংযুক্তিকরণের কাজ বাকি রয়েছে। তাই নির্বাচনের দিনক্ষণ পিছিয়ে দেওয়া হোক। কিন্তু হাইকোর্ট শুক্রবার স্পষ্ট বলে দিল, প্রাকৃতিক বিপর্যয় ছাড়া ভোট পিছিয়ে দেওয়ার নিয়ম নেই। সুপ্রিম কোর্টের তেমনই নির্দেশ রয়েছে। অতএব আদালতে পূর্বনির্ধারিত দিনক্ষণ অনুযায়ী ১৬ জুনের মধ্যেই ভোট করতে হবে রাজ্যকে। রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল জয়ন্ত মিত্রকে উদ্দেশ করে প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুর এ দিন বলেন, ‘‘আপনি আমাদের নির্দেশ না মানতে পারলে সুপ্রিম কোর্টে যেতে পারেন।’’ আর, রাজ্য নির্বাচন কমিশনের আইনজীবী নয়নচাঁদ বিহানীর প্রতি প্রধান বিচারপতির নির্দেশ, ‘‘কমিশনকে
তার সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা পালন করতে বলুন।’’
হাইকোর্টের এই নির্দেশের পরে রাজ্য সরকারের সামনে দু’টি পথ খোলা রয়েছে। হয় অবিলম্বে সাতটি পুরসভা (রানিগঞ্জ, জামুড়িয়া, আসানসোল, কুলটি, বালি, বিধাননগর ও রাজারহাট-গোপালপুর) নির্বাচনের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে হবে, নয় হাইকোর্টের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে যেতে হবে। কী করা হবে, তাই নিয়ে রাজ্য এ দিন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি। পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বলেন, ‘‘আমরা আইন দফতরের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেব।’’ হাইকোর্টের নির্দেশ নিয়ে এ দিন বিকেলে নবান্নে আইনমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য ও পুরসচিব বি পি গোপালিকার সঙ্গে বৈঠকেও বসেন ফিরহাদ। নবান্নর একটি সূত্রের খবর, রাজ্য সরকার সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার কথাই ভাবছে।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে অবশ্য তাঁর অবস্থান এখনও পরিষ্কার করেননি। সন্ধ্যায় নবান্ন থেকে বেরনোর মুখে তাঁকে হাইকোর্টের নির্দেশ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে মমতা শুধু বলেন, ‘‘আমরা খুব ভাল করেই জিতব।’’ মুখ্যমন্ত্রী এই কথা বলে ঠিক কী বার্তা দিতে চেয়েছেন, তা নিয়ে তাঁর দলেই ধন্দ রয়েছে। ওই মন্তব্য কি হাইকোর্টের নির্দেশ মেনে নির্বাচনে যাওয়ার ইঙ্গিত? ওই পুরসভাগুলিকে পুর নিগমের সঙ্গে সংযুক্তির পরে নির্বাচনে যাওয়ার ইঙ্গিত? নাকি সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার ইঙ্গিত? পরিষ্কার নয় দলের নেতাদের কাছেই। বিরোধীরা অবশ্য দাবি করছেন, মুখ্যমন্ত্রীর এই কথা থেকে স্পষ্ট, পুর নিগম গড়ার জন্য ভোট আটকে রাখাটা নেহাতই কথার কথা ছিল। সিপিএম রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সুজন চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘ভোট হবে কি না, তার উত্তর না দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, আমরা জিতব। অর্থাৎ হাইকোর্টের নির্দেশ বা মানুষের ভোট দেওয়ার অধিকার নিয়ে তাঁর মাথাব্যথা নেই। বোর্ড দখল করা নিয়েই তিনি চিন্তিত।’’
রাজ্য নির্বাচন কমিশন কিন্তু এখনই সাতটি পুরসভা নির্বাচন করানোর জন্য তৈরি। আগের দিন, অর্থাৎ বৃহস্পতিবারেই প্রধান বিচারপতির এজলাসে তারা বলেছিল, রাজ্য সরকারের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের জন্যই অপেক্ষা করা হচ্ছে। এ দিন হাইকোর্টের রায়ের পরে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায় আলাদা করে কোনও প্রতিক্রিয়া দিতে চাননি। এক প্রতিনিধিকে দিয়ে তিনি বলে পাঠান, ‘‘কমিশনের কিছু বলার থাকলে যথাসময়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে তা জানিয়ে দেওয়া হবে।’’ কমিশন সূত্রে খবর, এই নির্বাচন নিয়ে আগামী সোমবার তারা সর্বদলীয় বৈঠক ডেকেছে।
এর আগে সাতটি পুরসভার নির্বাচন নিয়ে গত ১৬ এপ্রিলই নিজেদের অবস্থান জানিয়ে দিয়েছিল প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুর ও বিচারপতি জয়মাল্য বাগচীর ডিভিশন বেঞ্চ। দু’মাসের মধ্যে ওই নির্বাচন সেরে ফেলতে বলা হয়েছিল। নির্বাচন কমিশন এ ব্যাপারে কী করছে? কমিশনের তরফে হাইকোর্টে জানানো হয়েছে, তারা ওই সাতটি পুর নির্বাচনের জন্য ১৫ জুন তারিখটি ঠিক করেছে। কিন্তু পুর আইন অনুযায়ী পুরভোটের বিজ্ঞপ্তি জারি করার কথা রাজ্য সরকারের। ওই বিজ্ঞপ্তি জারি না হওয়া পর্যন্ত কমিশনের কিছু করার নেই। রাজ্য নির্বাচন কমিশন সূত্রে আদালতে এ-ও বলা হয়, নির্বাচনের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ এবং ভোট গ্রহণের মধ্যে ন্যূনতম ২৪ দিন সময় থাকা উচিত। ১৫ জুন পুরভোট করাতে হলে ২১ মে-র মধ্যে বিজ্ঞপ্তি জারি করতেই হবে রাজ্য সরকারকে।
রাজ্য সরকার কী চাইছিল? রাজ্য সরকার হাইকোর্টকে জানিয়েছিল, আসানসোল পুর নিগমের সঙ্গে কুলটি, রানিগঞ্জ, জামুড়িয়া পুরসভাকে অন্তর্ভুক্ত করতে চায় তারা। একই ভাবে বিধাননগর ও রাজারহাট-গোপালপুর পুরসভাকে একসঙ্গে জুড়ে এবং হাওড়া পুর নিগমের সভার সঙ্গে বালি পুরসভার ওয়ার্ড জুড়ে দু’টি পুর নিগম তৈরি করার পরিকল্পনা রয়েছে। গত বছর রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে। এ দিন রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল জয়ন্ত মিত্র আদালতে বলেন, সাতটি পুরসভার এই সংযুক্তিকরণের কাজ এখনও শেষ হয়নি বলেই ১৬ জুনের মধ্যে নির্বাচন করানো সম্ভব হচ্ছে না। সেই কারণেই হাইকোর্টের কাছে আবেদন, ১৬ এপ্রিলের নির্দেশ পুনর্বিবেচনা করা হোক। এ কথা শুনে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘‘আমাদের নির্দেশ আমরা পুনর্বিবেচনা করতে পারি না। আমরা সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনেই ১৬ এপ্রিল ওই নির্দেশ দিয়েছি।’’ হাইকোর্টের প্রবীণ আইনজীবীদের একাংশ জানান, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়া কোনও নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া যায় না বলে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ রয়েছে। প্রধান বিচারপতি সেটাই মেনেছেন।
এর আগে পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে টালবাহানা করে সুপ্রিম কোর্ট অবধি গিয়েছিল রাজ্য সরকার। কলকাতা পুরভোট মেয়াদ ফুরনোর আগেই হয়েছে। এ দিনের রায়ের পরে রাজ্য সরকারকে কটাক্ষ করে বিরোধীরা বলেন, কখন কোন নির্বাচন পিছোবে বা এগোবে, সেই ব্যাপারে সরকারের সিদ্ধান্তে কোনও স্থিরতা নেই! বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রর মন্তব্য, ‘‘ওঁরা ফের সুপ্রিম কোর্টে যান কি না, দেখতে হবে! তবে এটা খুব দুর্ভাগ্যজনক যে, সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্বের কথা আদালতকে স্মরণ করিয়ে দিতে হচ্ছে!’’ সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে রাজ্যের ব্যর্থতা বারবার আদালতে প্রমাণিত হচ্ছে বলে দাবি বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যের। আর কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়া বলেন, ‘‘মাননীয় বিচারপতিরা যা বলেছেন, রাজ্য সরকার ও রাজ্য নির্বাচন কমিশনের তা মেনে নেওয়া উচিত।’’