Couple

বিয়ের শংসাপত্র সঙ্গে নিয়ে শহরে আসেন কুতুবুদ্দিন-সুজাতারা

রবিবার চুঁচুড়ার একটি লজে ঘর নিতে গিয়ে হয়রানির মুখে পড়েছিলেন বর্ধমান শহরের বাসিন্দা তৌসিফ হক ও তাঁর স্ত্রী জয়ন্তী বিশ্বাস।

Advertisement

রাজীব চট্টোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ জানুয়ারি ২০২১ ০৪:২১
Share:

—প্রতীকী ছবি

কলকাতায় এলে বিয়ের শংসাপত্রের প্রতিলিপি সঙ্গে নিতে ভোলেন না দক্ষিণ দিনাজপুরের শেখ কুতুবুদ্দিন ও তাঁর স্ত্রী সুজাতা চক্রবর্তী। ওই শংসাপত্র না থাকলে শহরের হোটেল বা লজে ঘর ভাড়া পেতে কত প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়, তা তাঁদের জানা। একই কারণে বাইরে বেরোলে বিবাহের শংসাপত্র সঙ্গে রাখেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার স্কুলশিক্ষক মহম্মদ রফিউদ্দিন ও তাঁর স্ত্রী শর্মিলা। কলকাতার একটি লজে ঘর ভাড়া নিতে গিয়ে একঝাঁক প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছিল ভিন্ ধর্মের ওই দম্পতিকে। আবার বীরভূমের ইলামবাজারের স্কুলশিক্ষক জিন্না আহমেদ যখন অসুস্থ স্ত্রী পূর্ণিমা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে কলকাতায় আসতেন চিকিৎসার জন্য, তখন ব্যাগেই রেখে দিতেন বিবাহের শংসাপত্র। কারণ তাঁরা জানতেন, ঘর পেতে হলে যে প্রশ্নের উত্তর তাঁদের দিতে হবে তা হল— জিন্নার স্ত্রীর নাম কী করে পূর্ণিমা হয়।

Advertisement

রবিবার চুঁচুড়ার একটি লজে ঘর নিতে গিয়ে হয়রানির মুখে পড়েছিলেন বর্ধমান শহরের বাসিন্দা তৌসিফ হক ও তাঁর স্ত্রী জয়ন্তী বিশ্বাস। সেই ঘটনার কথা শুনে সুজাতা, রফিউদ্দিন ও জিন্নার স্মৃতিতে উঁকি দিয়েছে, তাঁদের সঙ্গে ঘটা সেই সব ঘটনা।

বছরখানেক আগের কথা। কাকদ্বীপের একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন রফিউদ্দিন ও শর্মিলা। শর্মিলা বলেন, ‘‘বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলাম। শিয়ালদহ থেকে খুব ভোরে ট্রেন ছাড়ার কথা ছিল। কাকদ্বীপ থেকে অত সকালে পৌঁছতে পারব না। তাই ঠিক করি, আগের দিন শিয়ালদহ স্টেশনের আশপাশে কোনও অতিথিশালায় ঘর ভাড়া নিয়ে রাতটুকু কাটিয়ে দেব।’’

Advertisement

আরও পড়ুন: বিবেক মিছিল তথা দ্বৈরথে নেই শুভেন্দু, আছেন শুধু মাল্যদানে

তার পরে? শর্মিলার বর্ণনায়, ‘‘একটি লজে গিয়েছিলাম। কিন্তু কিছুতেই ঘর দিতে রাজি হননি ম্যানেজার। আমাদের স্বামী-স্ত্রী বলেই মানতে চাইছিলেন না। বিবাহের শংসাপত্র দেখিয়েও লাভ হয়নি।’’ শেষ পর্যন্ত অন্য একটি লজে সেই রাত কাটাতে হয়েছিল ওই দম্পতিকে। কুতুবুদ্দিনের প্রশ্ন, ‘‘বাইরে থাকার প্রয়োজন তো যে কোনও সময়ে হতে পারে। তা হলে কি সব সময়ে বিয়ের শংসাপত্র সঙ্গে নিয়ে বেরোতে হবে?’’

আরও পড়ুন: ক্যাপিটলে হামলার পর ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ইমপিচমেন্টের প্রস্তাব ডেমোক্র্যাটদের

কী বলছে আইন?

আইনজীবী জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘হোটেল, লজ বা অতিথিশালায় ঘর পেতে বিয়ের শংসাপত্র দেখাতে হবে, এমন কথা কোনও আইনে বলা নেই। দুই ইচ্ছুক সাবালক (কনসেন্টিং অ্যাডাল্ট) চাইলেই পরিচয়পত্র দেখিয়ে ঘর ভাড়া নিতে পারেন। তাঁদের থেকে বিয়ের শংসাপত্র চাওয়ার অধিকার কারও নেই।’’ পুলিশের অতি সক্রিয়তার কারণে অনেক সময়ে এই ধরনের ঘটনা ঘটে বলে তাঁর দাবি। জয়ন্তবাবু বলেন, ‘‘হোটেলে যৌন ব্যবসা চলার অজুহাতে পুলিশ অনেক সময়ে সেখানে তল্লাশি চালায়। বিনা কারণে হোটেল ব্যবসায়ীদের হেনস্থা করে। পুলিশের অলিখিত নির্দেশ মেনে অনেক হোটেল বা লজের মালিক ঘর ভাড়া নিতে আসা দম্পতির থেকে বিয়ের শংসাপত্র চান। কিন্তু এটা আইনবিরুদ্ধ কাজ। কেউ চাইলে সংশ্লিষ্ট হোটেল বা লজের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেন।’’

অনেক ‘সামাজিক’ বাধা পেরিয়ে পুলিশ-প্রশাসনের শীর্ষ মহলের হস্তক্ষেপে স্ত্রী সুজাতাকে নিজের কাছে আনতে পেরেছিলেন দক্ষিণ দিনাজপুরের দৌলতপুরের বাসিন্দা শেখ কুতুবুদ্দিন। তৌসিফের ঘটনা শুনে বললেন, ‘‘এ আর নতুন কী! আমাদের সঙ্গেও একই জিনিস ঘটেছিল। সুজাতা কলকাতার একটি প্রতিষ্ঠানে মাস্টার অব সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার (এমএসডব্লিউ) পড়তেন। সে দিন ওঁর একটি পরীক্ষা ছিল। শিয়ালদহ পৌঁছতে রাত হয়ে গিয়েছিল। স্টেশন সংলগ্ন একটি লজে গিয়েছিলাম ঘর ভাড়া নিতে। ভিন্ ধর্মে বিয়ে করায় আমাদের ঘর দিতে রাজি হননি লজের মালিক। তাঁরা আমাদের দম্পতি বলেই মানতে চাননি। অনেক চেষ্টার পরে অন্য একটি লজে ঘর ভাড়া পাই। তার পর থেকে কলকাতা গেলে সঙ্গে বিয়ের শংসাপত্রটি রাখি।’’ সুজাতা বলেন, ‘‘সেই রাতের কথা ভেবে এখনও আতঙ্ক হয়। তাই তৌসিফ ও জয়ন্তীকে কী পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে, আমি বুঝতে পারি।’’

কয়েক বছর আগে মৃত্যু হয়েছে বোলপুরের বাসিন্দা জিন্না আহমেদের স্ত্রী পূর্ণিমাদেবীর। ইলামবাজারের একটি স্কুলের শিক্ষক জিন্না বলেন, ‘‘বহু বার চিকিৎসার জন্য স্ত্রীকে কলকাতায় নিয়ে আসতে হত। লজ বা অতিথিশালায় ঘর চাইতেই একই প্রশ্ন করা হত আমাদের— ‘জিন্নার স্ত্রীর নাম কী করে পূর্ণিমা কী হয়’? আমরা বিশেষ বিবাহ আইনে বিয়ে করেছিলাম। এক লজ থেকে অন্য লজে ঘুরতে হত ঘর পেতে।’’ তাঁর আক্ষেপ, ‘‘বাংলার রাজনীতি এখন অন্য খাতে বইছে। তাই ভিন্ ধর্মে বিয়ে করেছেন, এমন দম্পতিদের মধ্যে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। সঙ্গী নির্বাচন করার অধিকারটুকুও কি থাকবে না আমাদের?’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement