গ্রাফিক: সৌভিক দেবনাথ।
সপ্তাহখানেক আগে প্রত্যহৃত হয়েছে অনাস্থা। তৃণমূলের বিরুদ্ধে অনাস্থা এনেছিল তৃণমূলই। হালিশহরের গুঞ্জনে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে— বালুর বিরুদ্ধে অনাস্থা এনেছিলেন অর্জুন। বালু অর্থাৎ উত্তর ২৪ পরগনা জেলা তৃণমূলের সভাপতি তথা রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক এবং অর্জুন অর্থাৎ ভাটপাড়ার বিধায়ক তথা ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের দাপুটে নেতা অর্জুন সিংহ— দু’জনেই সে কথা অস্বীকার করছেন। কিন্তু, ১১ জন কাউন্সিলরকে ঘিরে রহস্য জমজমাট। তাঁরা আদৌ হালিশহরে রয়েছেন, নাকি দূরে কোথাও নতুন কোনও সমীকরণ পাকিয়ে তুলছেন, জোর ধোঁয়াশা তা নিয়ে।
২৩ আসনের পুরসভা হালিশহর। কিন্তু ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তথা ভাইস চেয়ারম্যান দেবাশিস (রাজা) দত্ত অনেক দিন ধরেই এলাকা ছাড়া। আর ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তারক চৌধুরী জেলে। ফলে পুরসভার অধিবেশনে নিয়মিত যোগদান করেন ২১ জন। অতএব ১১ জন যাঁর দিকে, পুরসভা তাঁর। ঠিক সেই ১১ জন কাউন্সিরলকে নিয়েই এখন বেজায় হইচই হালিশহরে।
সম্প্রতি চেয়ারম্যান অংশুমান রায়ের বিরুদ্ধে অনাস্থা এনেছিলেন তৃণমূলেরই কাউন্সিলররা। জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের ঘনিষ্ঠ অংশুমান। অর্জুন-পন্থীদের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরেই তাঁর বনিবনা কম। ভাটপাড়া, কাঁচরাপাড়ার মতো পুরসভাগুলিতে অর্জুন যে ভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছেন, অংশুমানের বাধায় হালিশহরে ততটা পারেননি বলে তৃণমূলেরই একাংশের দাবি। সেই কারণেই অংশুমানকে সরাতে অর্জুন সক্রিয় বলে তৃণমূলের ওই অংশের মত।
আরও পড়ুন: চোর অপবাদ দিয়ে বাবা-ছেলেকে ব্যাপক মারধর ট্রেনে, টাকা ছিনতাই!
আরও পড়ুন: কর্ণকে ছাড়াতে কাঁথি থানায় হুমকি ফোন! বাকি দুষ্কৃতীরা এখনও অধরা
হালিশহর পুরসভা আবার বীজপুর বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে পড়ে। অর্থাৎ মুকুল রায়ের ছেলে শুভ্রাংশ রায়ের কেন্দ্র। শুভ্রাংশু তৃণমূলে থাকলেও মুকুল এখন বিজেপিতে। কিন্তু দলে শুভ্রাংশুর গুরুত্ব অনেকটাই খর্ব হয়ে গিয়েছে। ফলে তৃণমূলে থাকাকালীন মুকুল যে ভাবে কোণঠাসা করে রেখেছিলেন অর্জুনকে, শুভ্রাংশু তা পারেননি। এলাকায় মুকুল অনুগামী হিসেবে যাঁরা এক সময়ে পরিচিত ছিলেন, তাঁদেরই অনেকে এখন অর্জুন শিবিরে নাম লিখিয়েছেন বলে শোনা যায়। অর্থাৎ মুকুল রায় বিজেপিতে যাওয়ায় এলাকায় অর্জুন সিংহের প্রভাব আগের চেয়ে বেড়েছে। তাতেই তৈরি হয়েছে সঙ্ঘাতের নতুন ক্ষেত্র। জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের অনুগামীদের সঙ্গে বিরোধ বেড়েছে অর্জুন-পন্থীদের। হালিশহরে চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অনাস্থা সেই বিরোধেরই ফল বলে তৃণমূল কর্মীরা জানাচ্ছেন।
অনাস্থা আনা হলেও, শেষ পর্যন্ত অংশুমান রায়ের নেতৃত্বাধীন বোর্ড ফেলা যায়নি। গোলমালের খবর তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে পৌঁছেছিল। নেতৃত্বের অসন্তোষের আভাস পেয়েই অনাস্থা প্রত্যাহার করা হয় বলে খবর। কিন্তু অর্জুন সিংহ কোনও বিষয়েই সহজে হাল ছাড়ার পাত্র যে নন, তা গোটা ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলেই সুবিদিত। তাই অংশুমান রায়কে সরানোর চেষ্টা থামেনি। অংশুমানের কাজকর্মে কেউ সন্তুষ্ট নন, এমন কোনও চিঠিতে কাউন্সিলরদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে দিয়ে সই করিয়ে নেওয়ার চেষ্টা শুরু হয়েছে বলে খবর। ১১ জন কাউন্সিলরকে অর্জুন সিংহ পাশে পেয়ে গিয়েছেন বলে হালিশহরের তৃণমূল কর্মীদের একাংশের দাবি।
বৃহস্পতিবার পুরসভার বোর্ড মিটিং ডাকা হয়েছিল। কিন্তু অংশমানের বিরোধী শিবিরে থাকা কাউন্সিলররা বোর্ড মিটিঙের চিঠি নেননি বলে অভিযোগ। ১১ জন কাউন্সিলর হালিশহরেই নেই, এমনও দাবি করছে একটি অংশ। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে পুরসভার কাজকর্ম চালু রাখাই কঠিন হয়ে পড়বে চেয়ারম্যানের পক্ষে। ফলে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে জেলা তৃণমূলে।
দীর্ঘ দিন ধরে এলাকাছাড়া যিনি, সেই ভাইস-চেয়ারম্যান রাজা দত্তকে অনেক চেষ্টাতেও ফোনে ধরা সম্ভব হয়নি। চেয়ারম্যান অংশুমান রায়ও ফোন ধরেননি। চেয়ারম্যান পারিষদ বন্যা তালুকদার ফোন ধরেছিলেন। কিন্তু ১১ কাউন্সিলরের নিখোঁজ হওয়ার যে অভিযোগ উঠছে, সে বিষয়ে প্রশ্ন করতেই তিনি জবাব দিতে অস্বীকার করেন। চেয়ারম্যান পারিষদ বলেন, ‘‘আমি দলের অনুমতি ছাড়া কোনও কথা বলতে পারব না।’’
অর্জুন সিংহ কী বলছেন? অর্জুন সিংহ যাবতীয় অভিযোগ এবং জল্পনা নস্যাৎ করছেন। তিনি ফোনে আনন্দবাজার ডিজিটালকে বললেন, ‘‘সম্পূর্ণ ভুল খবর। কেউ নিখোঁজ নন। কাউকে নিখোঁজ করা আমার কাজও নয়। সবাই হালিশহরেই রয়েছেন।’’ ‘কাউন্সিলর নিখোঁজ’ নিয়ে জল্পনা নস্যাৎ করেই থামেননি তিনি। অর্জুন পাল্টা প্রশ্ন তুললেন, ‘‘অনাস্থা তো তুলে নেওয়া হয়েছে সাত-আট দিন আগেই। এখন কেউ নিখোঁজ থাকতে যাবেন কেন?’’ এর পরেই অর্জুনের স্বভাবসিদ্ধ হুঙ্কার, ‘‘আমার লোকজন কিছু করতে চাইলে এলাকা ছেড়ে চলে গিয়ে করবে না। এলাকায় থেকেই করবে।’’
জেলা তৃণমূলের সভাপতি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক কিন্তু পুরোপুরি নস্যাৎ করলেন না ‘কাউন্সিলর নিখোঁজ’ সংক্রান্ত জল্পনা। প্রথমে অর্জুনের মতোই জ্যোতিপ্রিয়ও বললেন, ‘‘অনাস্থা তো প্রত্যাহার হয়ে গিয়েছে। এখন তো ছ’মাস আর অনাস্থা আনা যাবে না। তা হলে নিখোঁজ হয়ে করবেটা কী?’’ তার পরে জ্যোতিপ্রিয় আভাস দিলেন যে, সমস্যা কিছুটা তৈরি হয়েছে, তবে মিটে যাবে। জ্যোতিপ্রিয়র ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রের খবর, যে ১১ জন নিখোঁজ বলে জল্পনা চলছে, তাঁদের অন্তত ৩-৪ জনের সঙ্গে জ্যোতিপ্রিয়র কথা হয়েছে। তাঁরা হালিশহরেই রয়েছেন। তবে ৭-৮ জন কাউন্সিলর বাইরে থাকলেও থাকতে পারেন।
পরিস্থিতি যে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নেই, তা অবশ্য জেলা তৃণমূলের সভাপতির মন্তব্যে স্পষ্ট। তিনি বলেন, ‘‘সমস্যা একটা হয়েছে। আমি তাড়াতাড়িই ওঁদের সবাইকে নিয়ে একটা বৈঠক করব। অংশুমানকে ডাকব। ওঁর বিরুদ্ধে যাঁরা, তাঁদেরও ডাকব। অর্জুন সিংহ, পার্থ ভৌমিক (নৈহাটির বিধায়ক), শুভ্রাশু রায়— সবাইকে নিয়েই বৈঠক করব। সব মিটে যাবে।’’