Coronavirus in West Bengal

হাসপাতালের অগ্রিম চাই ২ লক্ষ! মৃত্যু কোভিড আক্রান্ত বৃদ্ধার

এই ঘটনার পরে বেসরকারি হাসপাতালগুলির একাংশের কার্যকলাপ নিয়ে ফের প্রশ্ন উঠল।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা 

কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ অগস্ট ২০২০ ০৩:৫৫
Share:

ডিসান হাসপাতালের অ্যাকাউন্টে জমা পড়া টাকার রসিদ।

বেসরকারি হাসপাতালের জরুরি বিভাগের বাইরে অ্যাম্বুল্যান্সে পড়ে রইলেন কোভিড আক্রান্ত বৃদ্ধা। মায়ের চিকিৎসার জন্য অগ্রিম হিসেবে ৮০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন ছেলে। কিন্তু আরও দু’লক্ষ টাকা না-দেওয়ায় হাসপাতালের দোরগোড়ায় মরণাপন্ন রোগীকে অপেক্ষা করানো হল বলে অভিযোগ। ছেলের দাবি, হাসপাতালের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে দু’লক্ষ টাকা জমা পড়ার প্রমাণ পাওয়ার পরেই তমলুকের বাসিন্দা বছর ষাটের লায়লা বিবিকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন চিকিৎসকেরা। তত ক্ষণে সব শেষ। সোমবার রাতে ডিসান হাসপাতালে এই ঘটনার পরে বেসরকারি হাসপাতালগুলির একাংশের কার্যকলাপ নিয়ে ফের প্রশ্ন উঠল।

Advertisement

সেই প্রশ্নের ভিত গড়ে দিয়েছে স্বাস্থ্য কমিশনের একের পর এক অ্যাডভাইজ়রির পরেও বেসরকারি হাসপাতালগুলির উদাসীনতা। শনিবারই কমিশন অ্যাডভাইজ়রিতে জানিয়েছিল, কোভিড আক্রান্ত রোগীর পরিজনের কাছে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা বা আনুমানিক চিকিৎসা খরচের ২০ শতাংশের বেশি টাকা নেওয়া যাবে না (এত টাকাই বা জমা দিতে হবে কেন, সে প্রশ্নও উঠেছে তখনই)। তবে পরিবারের কাছে টাকা না-থাকলে আক্রান্তকে ভর্তি করে ১২ ঘণ্টা সময় দেওয়ার কথাও অ্যাডভাইজ়রিতে উল্লেখ রয়েছে। শুক্রবার স্বাস্থ্য ভবনও একটি অ্যাডভাইজ়রিতে রোগীকে স্থিতিশীল করে স্থানান্তর করার জন্য নার্সিংহোম এবং বেসরকারি হাসপাতালকে বলেছিল। হাসপাতাল থেকে কোভিড রোগীকে ফেরানো যাবে না বলে তারও আগে হুঁশিয়ারি দিয়েছে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর। কিন্তু আনন্দপুর থানায় হাসপাতালের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগে ছেলে নাজিম খান ঘটনাক্রমের যে বিবরণ দিয়েছেন, তা এই সকল পদক্ষেপকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

স্বাস্থ্য কমিশনের চেয়ারপার্সন অসীম বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘পঞ্চাশ হাজার টাকার বেশি অগ্রিম চাওয়া হলে অন্যায় কাজ করেছে। হাসপাতাল না কি রোগীর পরিজন— কে সত্যি কথা বলছেন তা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখলে স্পষ্ট হবে। পরিবার অভিযোগ করলে কমিশন যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেবে।’’ অভিযোগ খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার আশ্বাস দিয়েছেন স্বাস্থ্যসচিব নারায়ণস্বরূপ নিগমও। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অবশ্য দাবি, রোগী যখন এসেছিলেন, তখন কিছু করার ছিল না।

Advertisement

হাসপাতালের জবাব

প্র: কী ঘটেছিল?
উ: রোগীর পরিজনেরা সোমবার বিকালে অগ্রিম টাকা দিয়ে বেড বুক করে যান। এরপর রাত ৯টা ১০ মিনিট নাগাদ রোগীকে যখন আনা হয় তখন তাঁর বিপি, পালস কিছু ছিল না। চিকিৎসকেরা সিপিআর (কার্ডিওপালমোনারি রিসাসিটেশন) দেন। কিন্তু রোগী তাতে সাড়া দেননি। কিছু করার ছিল না বলেই রোগীকে আর ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হয়নি।

প্র: অগ্রিম টাকার অঙ্ক সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা বেঁধে দেওয়ার পরও তিন লক্ষ টাকা চাওয়া হল কেন?
উ: স্বাস্থ্য কমিশনের নির্দেশ অনুযায়ী প্রয়োজন ছিল না। রোগীর পরিজনেরা হয়তো নিশ্চিত হওয়ার জন্য বেশি টাকা দিয়েছিলেন। কত খরচ হতে পারে রোগীর পরিজনকে সে সম্পর্কে একটা ধারণা দেওয়া হয়। সেটাই বলা হয়েছে।

প্র: আপনাদের বিরুদ্ধে আগেও তিন লক্ষ টাকা অগ্রিম চাওয়ার অভিযোগ উঠেছে?
উ: বারবার দু’একজন কর্মীর জন্য হাসপাতালের নাম খারাপ হচ্ছে। কেন এটা হচ্ছে তা দেখতে হবে।

প্র: রোগী হাসপাতালে কখন এসেছিলেন?
উ: রাত্রি ৯টা ১০ মিনিট হবে।

প্র: রোগীর পরিজন তো বলছেন উনিশ মিনিট ধরে অ্যাম্বুল্যান্সেই ছিলেন রোগী?
উ: পাঁচ মিনিট এদিক-ওদিক হতে পারে। আমি সকালে হাসপাতালে পৌঁছে খোঁজ নিয়ে যা জেনেছি তাই বললাম।

প্র: সিপিআর ক’টা নাগাদ দেওয়া হয়?
উ: বলতে পারব না।

প্র: সিসি ফুটেজ দেখলেই তো বোঝা যাবে কখন রোগী এসেছেন? সিপিআর কখন দেওয়া হয়েছে?
উ: সিসি ফুটেজ দেখা হয়নি।

প্র: রোগী যখন এসেছিলেন তখন কিছু করার না থাকলে ন’টা ১৯ মিনিটে হাসপাতালের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে দু’লক্ষ টাকা লেনদেন হল কেন?
উ: কখন কী লেনদেন হয়েছে বলতে পারব না। খোঁজ নিয়ে যা জেনেছি তা-ই বললাম।

প্র: সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে কি ঘটনাক্রমের সময় জানাবেন?
উ: দেখছি।

তাপস মুখোপাধ্যায়, ডেপুটি ম্যানেজার, ডিসান হাসপাতাল

বুকে ব্যথা হওয়ায় গত ৮ অগস্ট ভোরে তমলুকের বাড়ি থেকে এনে পার্ক সার্কাসের বেসরকারি নার্সিংহোমে মাকে ভর্তি করান নাজিম। ভর্তির সঙ্গেই বৃদ্ধার কোভিড পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষ। সোমবার সকালে আক্রান্তকে ভেন্টিলেশনে দেন নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষ। বিকেলে কোভিড রিপোর্ট পজ়িটিভ আসার পরে রোগীকে স্থানান্তর করার জন্য বলা হয়। কোভিড রোগীকে স্থানান্তর করার ক্ষেত্রে শুক্রবার স্বাস্থ্যভবনের নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য দফতরের হেল্পলাইন নম্বরের সাহায্য নেওয়ার জন্য। বৃদ্ধার ছেলের অভিযোগ, সংশ্লিষ্ট বেসরকারি নার্সিংহোম থেকে তাঁকে হেল্পলাইন নম্বরের কথা জানানো হয়নি। কেন? নার্সিংহোমের জেনারেল ম্যানেজার কৌশিক চক্রবর্তী বলেন, ‘‘কোভিড আক্রান্ত প্রতিটি রোগীকে সরকারি না কি বেসরকারি হাসপাতালে যেতে চান তা জানতে চাওয়া হয়। এ ক্ষেত্রেও অন্যথা হওয়ার কথা নয়।’’ স্থিতিশীল করে স্থানান্তর প্রসঙ্গে তিনি জানান, রোগীর পরিজন উন্নত চিকিৎসা কেন্দ্রে রোগীকে নিয়ে যেতে চাইলে তাঁরা কী ভাবে আটকাবেন!

আরও পড়ুন: সংক্রমণ লক্ষ ছাড়াল, বাড়ল ২৪ ঘণ্টায় সুস্থতার হারও

ডিসান হাসপাতালের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র।

নাজিমের বক্তব্য, এক পরিচিতের মাধ্যমে তাঁরা জানতে পারেন আনন্দপুর থানা এলাকার ডিসান হাসপাতালে শয্যা খালি রয়েছে। বিকেল পাঁচটা নাগাদ সেখানে প্রথমে গেলে রোগীর ‘কেস সামারি’ আনতে বলা হয়। তা নিয়ে ঘণ্টাখানেক পরে ডিসানে পৌঁছলে নাজিমকে ১৫ নম্বর ঘরে দেখা করতে বলা হয়। অভিযোগপত্রে নাজিমের দাবি, হাসপাতালের এক কর্মী জানান, মায়ের চিকিৎসা বাবদ প্রথম পাঁচ দিন ৭০ হাজার টাকা খরচ হবে। পরিবার যেহেতু কোয়রান্টিনে চলে যাবে, তাই অগ্রিম তিন লক্ষ টাকা জমা করতে হবে। সেই সময় ডেবিট এবং ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে ৮০ হাজার টাকা জমা করে শয্যা ‘বুক’ করেন নাজিম। পার্ক সার্কাসের নার্সিংহোম থেকে মাকে ছুটি করিয়ে আনার সময় সেখানে ৯০ হাজার টাকা বিল মেটাতে হয়। রাত ন’টা নাগাদ অ্যাম্বুল্যান্সে মাকে নিয়ে ডিসানের জরুরি বিভাগে পৌঁছন নাজিমেরা। কিন্তু অভিযোগ, আরও দু’লক্ষ টাকা না দিলে রোগীকে অ্যাম্বুল্যান্স থেকে নামানোর অনুমতি দেননি হাসপাতালের কর্তব্যরত কর্মীরা।

নাজিম এ দিন জানান, ডেবিট এবং ক্রেডিট কার্ডের সে দিনের ঊর্ধ্বসীমা শেষ হয়ে যাওয়ায় তা দিয়ে টাকা তোলা আর সম্ভব ছিল না। মোবাইল খারাপ হওয়ায় ‘পে-টিমে’র মাধ্যমেও টাকা দিতে পারেননি। রাত ১২টার পরে ঊর্ধ্বসীমা উঠে গেলে কার্ড পেমেন্টের আশ্বাসেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অনড় ছিলেন বলে অভিযোগ। আক্রান্তের বড় ছেলে লতিফ খান আবু ধাবিতে কাজ করেন। নাজিমের কথায়, ‘‘দাদার সঙ্গে যোগাযোগ করলে টাকা পাঠানোর জন্য ঘণ্টাখানেক সময় চেয়েছিল। তার মধ্যে টাকা চলে আসবে বলা সত্ত্বেও মায়ের চিকিৎসা করল না। বলছে, ‘আপনারা আপনাদের কাজ করুন। আমরা আমাদের কাজ করছি’!’’ মায়ের অবস্থা জানার পরে দ্রুত দু’লক্ষ টাকা জোগাড় করে হাসপাতালের দেওয়া ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে আবু ধাবি থেকে টাকা পাঠিয়ে দেন লতিফ। টাকা পাঠানো হয়েছে বলার পরও চিকিৎসা শুরু হয়নি বলে অভিযোগ। নাজিমের দাবি, ডিসানের কর্তব্যরত কর্মী তাঁর হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে (৮৩৩৫০৬২৫০৩) লেনদেনের নথি পাঠাতে বলেন। ন’টা ১৯ মিনিটে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠানোর প্রমাণ ঢোকার পরে অ্যাম্বুল্যান্সে সিপিআর দেওয়ার ব্যবস্থা শুরু হয়। তত ক্ষণে সব শেষ।

পরিবারের অভিযোগ প্রসঙ্গে বেসরকারি হাসপাতালের ডেপুটি ম্যানেজার তাপস মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘রোগী যখন এসেছিলেন, তখন কিছু করার ছিল না। সিপিআর দিয়েও লাভ হয়নি। দু’লক্ষ টাকা না পাওয়া পর্যন্ত বৃদ্ধাকে চিকিৎসা দেওয়া হয়নি, এরকম হওয়ার কথা নয়। কারণ, রোগীর পরিবার অগ্রিম হিসাবে যা টাকা দিয়েছিল তা যথেষ্ট।’’ কিন্তু রোগীকে যদি একেবারে শেষ অবস্থায় আনা হয়ে থাকে, তা হলে অগ্রিম পাওয়ার পরও আরও দু’লক্ষ টাকা কেন নেওয়া হল? ডেপুটি ম্যানেজার বলেন, ‘‘লেনদেনের বিষয় বলতে পারব না। খোঁজ নিয়ে যা জেনেছি তাই বললাম।’’

মাতৃহারা ছেলে বলেন, ‘‘হাসপাতালের দোরগোড়ায় এসে শুধু টাকার জন্য মায়ের চিকিৎসা হল না। আমি ওদের পায়ে পড়েছিলাম। কিন্তু মুখের উপরে বলছে, টাকা দিন। তা হলে আপনার রোগী অ্যাম্বুল্যান্স থেকে নামবেন!’’

(জরুরি ঘোষণা: কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের জন্য কয়েকটি বিশেষ হেল্পলাইন চালু করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এই হেল্পলাইন নম্বরগুলিতে ফোন করলে অ্যাম্বুল্যান্স বা টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত পরিষেবা নিয়ে সহায়তা মিলবে। পাশাপাশি থাকছে একটি সার্বিক হেল্পলাইন নম্বরও।

• সার্বিক হেল্পলাইন নম্বর: ১৮০০ ৩১৩ ৪৪৪ ২২২
• টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-২৩৫৭৬০০১
• কোভিড-১৯ আক্রান্তদের অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-৪০৯০২৯২৯)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement