রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়। —ফাইল চিত্র
সুর আরও চড়ালেন রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়। গত কয়েক দিন ধরে টুইটারে হুঁশিয়ারি দিচ্ছিলেন রাজ্য সরকারের উদ্দেশে। এ বার টেলিভিশন চ্যানেলের সামনে মুখ খুললেন। এবিপি নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রাজ্য সরকার তথা মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে রীতি মতো তোপ দাগলেন তিনি। কম টেস্টিং, নিজামউদ্দিন-ফেরতদের ঠিক মতো চিহ্নিত না করা, করোনা সংক্রান্ত পরিসংখ্যান লুকিয়ে রাখা, রেশন দুর্নীতি, কৃষকদের হাতে কেন্দ্রীয় অনুদান পৌঁছতে না দেওয়া— এমন একগুচ্ছ অভিযোগ তুলেছেন রাজ্যপাল। শুধু ‘খারাপ সরকার চালনা’ বলে থেমে থাকেননি রাজ্যপাল, পশ্চিমবঙ্গে ‘অপরাধমূলক সরকার চালনা’ হচ্ছে বলেও এ দিন মন্তব্য করেছেন তিনি।
জগদীপ ধনখড় পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল হয়ে আসার পর থেকেই রাজভবনের সঙ্গে নবান্নের সঙ্ঘাত নতুন মাত্রায় পৌঁছে গিয়েছে। নানা ইস্যুতে রাজ্য সরকারের সঙ্গে রাজ্যপালের মতান্তর সামনে এসেছে। করোনা মোকাবিলায় লকডাউন শুরু হওয়ার পরে কিছু দিন সেই সঙ্ঘাতে বিরতি ছিল। কিন্তু লকডাউন ঠিক মতো কার্যকরী না হওয়ার অভিযোগকে ঘিরে ফের বাড়তে শুরু করে সঙ্ঘাত। গত কয়েক দিনে তা তুঙ্গে উঠে গিয়েছে।
রাজ্যের সব এলাকায় লকডাউনের নিয়মকানুন ঠিক মতো কার্যকর করা হচ্ছে না, অভিযোগ করছিল বিরোধী দলগুলো। তার পরে রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ের মুখেও সে কথার প্রতিধ্বনি শোনা যায়। তার সঙ্গে আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে তিনি বলেন, পুলিশ দিয়ে লকডাউন কার্যকর করা না গেলে আধাসেনা নামানো হোক। রাজ্যপালের এই মন্তব্য নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছিল রাজ্যের রাজনৈতিক শিবিরে। কিন্তু সে বিতর্ক রাজ্যপালকে থামাতে পারেনি। কখনও মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লিখে, কখনও চিঠি টুইটারে প্রকাশ করে, কখনও কেন্দ্রীয় দলের সঙ্গে সহযোগিতা করার নির্দেশ দিয়ে, কখনও সংবিধান মেনে চলার কথা মনে করিয়ে একের পর এক টুইট করতে থাকেন তিনি। এ বার টেলিভিশন চ্যানেলকে সাক্ষাৎকার দিয়ে আরও আক্রমণাত্মক ভাষায় সমালোচনা শুরু করলেন।
আরও পড়ুন: সঙ্ঘাত তো শেষ কালই, আজও কেন ঘরে বসে কেন্দ্রীয় দল?
এবিপি নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড় বলেছেন, ‘‘আমাদের যত বেশি সম্ভব টেস্টিং করাতে হবে। শুধুমাত্র টেস্টিং থেকেই জানা সম্ভব, এখানে পরিস্থিতি কতটা গুরুতর। আমাদের রাজ্যের টেস্টিং গড় জাতীয় গড়ের এক-তৃতীয়াংশের কাছাকাছি। এটা চিন্তার বিষয়।’’ করোনায় কত জন আক্রান্ত, কত জন মৃত, সে সব নিয়েও সঠিক তথ্য দেওয়া হচ্ছে না বলে রাজ্যপালের দাবি। তিনি বলেন— যে সব সংখ্যা রাজ্য সরকারের তরফে দেওয়া হচ্ছে, তা সাধারণ মানুষ বা মিডিয়া, কারও কাছেই বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না।
পশ্চিমবঙ্গে করোনা মোকাবিলার নামে রাজনীতি হচ্ছে বলে রাজ্যপাল মনে করছেন। তাঁর কথায়, ‘‘আমি খুব বড় ধাক্কা খেয়েছি এটা দেখে যে, রাজনীতি মানুষকে কতটা বিপদে ফেলতে পারে।’’ দিল্লিতে তবলিগি জামাতের সমাবেশ থেকে যাঁরা ফিরেছেন, তাঁদের চিহ্নিত করার ব্যাপারেও পশ্চিমবঙ্গ সরকার সঠিক পদক্ষেপ করেনি বলে অভিযোগ রাজ্যপালের। তিনি বলেন, ‘‘নিজামউদ্দিন মরকজ থেকে ফেরা লোকেদের নিয়ে দেশের সব প্রান্তেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তাঁদের চিহ্নিত করা হচ্ছে, কোয়রান্টিনে পাঠানো হচ্ছে।’’ কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে নিজামউদ্দিন ফেরতদের সকলকে খুঁজে বার করা হয়নি বলে রাজ্যপালের অভিযোগ। মুখ্যমন্ত্রীকে সে বিষয়ে প্রশ্ন করায় তিনি অত্যন্ত আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে জবাব দিয়েছেন বলেও রাজ্যপাল এ দিন মন্তব্য করেছেন। ধনখড়ের কথায়, ‘‘তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি অত্যন্ত আক্রমণাত্মক ভাবে বলছেন, সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন করবেন না।’’
লকডাউনে সকলের কাছে ঠিক মতো ত্রাণ পৌঁছচ্ছে না বলেও রাজ্যপাল অভিযোগ করেছেন টিভি চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে। পশ্চিমবঙ্গে রেশন বণ্টন নিয়ে দুর্নীতি চলছে বলে তাঁর দাবি। ‘নাটকীয়তা’র আশ্রয় নিয়ে করোনার মোকাবিলা করা যাবে না— কটাক্ষ রাজ্যপালের।
আরও পড়ুন: ত্রাণ নিয়ে বিক্ষোভ, বাদুড়িয়ায় জনতা-পুলিশ খণ্ডযুদ্ধ, মাথা ফাটল পুলিশের
প্রধানমন্ত্রী কিসান সম্মান নিধি (পিএমকিসান)-র আওতায় পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের টাকা পাওয়ায় রাজ্য সরকার আটকে রেখেছে, অভিযোগ করেছেন ধনখড়। সাক্ষাৎকারে তাঁর দাবি, এত দিনে পশ্চিমবঙ্গের ৭০ লক্ষ কৃষক ওই প্রকল্পের আওতায় ১০ হাজার টাকা করে পেয়ে যেতেন। রাজ্যপালের কথায়, ‘‘পুরো দেশের কৃষকরা এই প্রকল্পের সুবিধা পাচ্ছেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের সরকার কেন্দ্রকে তথ্য না দেওয়ায় রাজ্যের কৃষকরা তা পেলেন না।’’ এর পরেই রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে প্রবল তোপ দেগে রাজ্যপাল বলেন, ‘‘এটাকে আমি খারাপ সরকার চালনা বলছি, অপরাধমূলক সরকার চালনা বলছি।’’
বুধবার টুইটারেও রাজ্য সরকারকে কেন্দ্রের সঙ্গে সমন্বয় রেখে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন রাজ্যপাল। তিনি লিখেছেন, ‘‘সাংবিধানিক ব্যবস্থা মেনে চলাতেই আমাদের গণতন্ত্রের সাফল্য নিহিত। সংবিধান বলে কেন্দ্র এবং রাজ্যের সমন্বয়মূলক এবং গঠনমূলক কাজের কথা— উভয়েরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।’’ টুইটের শেষ লাইনে রাজ্যপাল লিখেছেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে আবেদন, রাজ্যের স্বার্থে নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে সমন্বয় রেখে কাজ করুন।’’