Labour News

কাজ নেই, ইদ যেতেই ফের ভিনরাজ্যের পথে পরিযায়ী শ্রমিকরা

এই বছরের ইদের মতো খারাপ পরব বোধহয় কোনও দিন কাটাননি এই শ্রমিকরা। বাস ঠিক হলেই ফের ভিন রাজ্যে রুটির খোঁজে পাড়ি দেবেন।

Advertisement

সিজার মণ্ডল

ভগবানগোলা (মুর্শিদাবাদ) শেষ আপডেট: ০৪ অগস্ট ২০২০ ১৬:৫৮
Share:

গ্রামে কাজ পাব না কেন? প্রশ্ন ভগবানগোলার এই শ্রমিকদের। ছবি: অসীম রায়চৌধুরী

আরজিনার মন খারাপ। একই সঙ্গে স্বস্তিও আছে। তবে মন খারাপটাই বেশি। আর তো কয়েকটা দিন মাত্র। হাতের গতি বাড়ান আরজিনা। বাড়ির দাওয়ায়, ছেলেকে কোলে নিয়েই ঝুঁকে পড়ে এক মনে বিড়ির পাতা কাটতে থাকেন। মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে তিন বছরের শিশু।

Advertisement

সন্ধের মধ্যে বিড়ি বাঁধা শেষ করে মহাজনের হাতে দিতে পারলে গোটা সপ্তাহের মজুরিটা মিলবে। এই টাকাটা এখন ভীষণ দরকার। ঠিকাদার বাস ঠিক করলেই ফের ভিন রাজ্যে পাড়ি দেবেন স্বামী ইব্রাহিম। তার আগেই জোগাড় করে ফেলতে হবে বাসের ভাড়া।

আরজিনার দাওয়া থেকে নাক বরাবর কয়েক কদম এগিয়ে গেলেই পদ্মা পাড়। সেখান থেকে শোনা যাচ্ছে ব্যস্ত মাঝিদের চিৎকার আর পাড়ের হাটে বিকিকিনির গুঞ্জন। দূর থেকে ভেসে আসছিল বক্সে বেজে চলা গানের আওয়াজ। ইদের ঠিক পরের দিন। পরব একদিন হলেও রেশ থেকে যায় ক’দিন ধরে। সে রকমই কোনও খাওয়া দাওয়ার আসর থেকে ভেসে আসছিল ওই গান। তবে সেই পরবের কোনও নাম নিশান বা রেশ মাত্র নেই আখরিগঞ্জ ঘাটের ঠিক পাশে এই শিবনগর, অর্থাৎ আরজিনাদের গ্রামে। মুর্শিদাবাদ জেলার ভগবানগোলা ব্লকের বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষা পদ্মা পাড়ে এক প্রত্যন্ত গ্রাম।

Advertisement

লকডাউনে ওড়িশাতে আটকে পড়া ইব্রাহিমকে অনেক কষ্টে, শেষ সম্বল গয়নাটুকু বন্ধক দিয়ে, বাড়ি ফিরিয়ে এনেছিলেন আরজিনা। একটাই সান্ত্বনা ছিল, বিদেশ বিভুঁইয়ে পড়ে থাকবে না সবচেয়ে কাছের মানুষটা। কিন্তু সেই মানুষটাকেই ফের ‘বিদেশে’ পাঠাতে এখন আর একবার টাকার জোগাড় করছেন। ব্যস্ত হাতে কাজ করতে করতে, প্রায় নিজের মনেই বলে ওঠেন তিন সন্তানের মা, ‘‘না গেলে উপায় কী? এখানে তো কোনও রোজগার নেই। খাব কী? বাচ্চাদেরই বা কী খাওয়াব?”

আরও পড়ুন: শ্রমিক স্পেশালে আয় ৪৩০ কোটি, ‘গরিবদের লুট’​

গ্রামে ফেরার পর বেকার বসে ছিলেন ইব্রাহিম। রেশনের চাল আর আরজিনার বিড়ি বাঁধার সপ্তাহে ৫০০ টাকাই ছিল গোটা পরিবারের গ্রাসাচ্ছদনের ভরসা। গত তিন দিন ধরে মাঠে পাট কাটার কাজ পেয়েছেন ইব্রাহিম। মজুরি একশো থেকে বড় জোর দেড়শো টাকা। আরজিনার সঙ্গে কথা বলার মাঝখানেই মাঠ থেকে ফিরে এসেছেন ইব্রাহিম। দাওয়ায় বসা স্ত্রীকে পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকতে গিয়ে আবার ফিরে দাঁড়ালেন। ‘‘ওড়িশাতে দিনে মজুরি ছিল ৫০০ টাকা। এখানে সে টাকা দূরে থাক, অর্ধেক মজুরিও মেলে না”— গলার সুরে হতাশাটা স্পষ্ট।

কাজ নেই। গত চার মাস ধরে বেকার আয়ুব শেখ। গোটা বাড়ি জুড়েই বিষন্নতা।

বাঁশ আর বাখারির কাঠামোর উপর পাটকাঠিতে ঘেরা দেওয়াল। মাথার উপর পুরনো জঙ ধরা করোগেটেড টিনের চাল। জানলাহীন ঘরে একটাই দরজা। ক্যানেস্তারা টিন কেটে তৈরি দরজা। জন্ম ইস্তক আরজিনা বা ইব্রাহিম গরিব মানুষ। ভিটের জমিটুকু ছাড়া আর কিছু কোনও দিনই ছিল না। কিন্তু তাতেও এই বছরের ইদের মতো খারাপ পরব বোধহয় কোনও দিন কাটাননি তাঁরা। ইব্রাহিমের বলতে থাকেন, ‘‘এ ভাবে কী করে চলবে বলুন তো? আজ একমাস পরে পর পর তিন দিন কাজ পেলাম। তাও এত কম মজুরি। কী ভাবে পাঁচজনের চলে?” পাশ থেকে আরজিনার গলার আওয়াজ, ‘‘ছেলে মেয়েদের এ বছর একটা নতুন জামাও কিনে দিতে পারিনি। কোথা থেকে পারব। যা জমানো ছিল তা সব শেষ। আর বাকি যা রোজগার তা তো দিনে খেতেই শেষ।”

আরও পড়ুন: ২৪ ঘণ্টায় রাজ্যে মৃত ৫৩, শয্যা বাড়ছে​

ব্যাগ গুছিয়ে তৈরি ইব্রাহিম। ঠিকাদাররা বাস বুক করার চেষ্টা করছেন। বাস ঠিক হলেই ফের ভিন রাজ্যে রুটির খোঁজে পাড়ি দেবেন। বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষা মুর্শিদাবাদের ভগবানগোলা ১ এবং ২ নম্বর ব্লকের প্রায় ৭৫ শতাংশ পরিবার থেকেই কেউ না কেউ ভিন রাজ্যে কাজ করেন। কেউ রাজমিস্ত্রির কাজ করেন, কেউ বা প্লাম্বিংয়ের কাজ অথবা আরও নানান রকম দিনমজুরির কাজ।

ইদের আনন্দ নেই। শিবনগর গ্রামে রেশ মাত্র নেই উৎসবের।

ভগবানগোলা থেকে সঙ্গী হয়েছিলেন ফরাক্কা কলেজের শিক্ষক আসিফ ফারুক। লকডাউনের সময়ে নানা রাজ্যে আটকে পড়া পরিযায়ী শ্রমিকদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে উদ্যোগী হওয়া বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চের সদস্য। হাতের তালুর মতো চেনেন গোটা এলাকা। শিবনগর থেকে আখরিগঞ্জ ঘাটের দিকে যেতে যেতে বলেন, ‘‘গোটা মুর্শিদাবাদ জেলার অর্থনীতি অনেকাংশে নির্ভরশীল এই পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর। গোটা দেশে সর্বত্র পাবেন এখানকার শ্রমিকদের।” ফারুকের সঙ্গে ছিলেন শিবরামপুরের শরাফ আবেদিন।

আরও পড়ুন: বঙ্গোপসাগরে ঘনীভূত নিম্নচাপ, কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গে বৃষ্টি চলবে কালও

সদ্য ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ শরাফ বলেন, ‘‘গোটা জেলার পরিযায়ী শ্রমিকদের সামগ্রিক ছবি দেখতে হলে চলুন পদ্মার চরের ফেলুর মোড়ে।” আখরিগঞ্জ ঘাট থেকেই ভুটভুটি যায় পদ্মার চরে। নদীর জলের দিকে আঙুল দেখিয়ে শরাফ বলেন, ‘‘এই জলের তলাতেই ছিল আখরিগঞ্জ অঞ্চলের অর্ধেকের বেশি এলাকা। পাড় ভাঙতে ভাঙতে পদ্মার জলের তলায় চলে গিয়েছে এখানকার আগের বিডিও অফিস থেকে শুরু করে মূল গঞ্জ। তার পর গড়ে উঠেছে নদীর মাঝে চর। ভাঙনে জমিহারা লোকজন গিয়ে ভিটে তৈরি করেছে চরের মাটিতে।”

প্রায় তিন কিলোমিটার লম্বা আড়াই কিলোমিটার চওড়া এই চড়া। তার উপর সার সার পাটকাঠির ঘর। বছরের প্রায় তিন মাস এই চর জলের তলায় থাকে। ভেসে যায় এই পাটকাঠি আর টিনের ছাউনি দেওয়া ভিটে। চরের প্রায় ৭ হাজার বাসিন্দার ঠাঁই হয় নির্মল চরের জুনিয়র হাই স্কুলে। ঘাট থেকে পায়ে হেঁটে কয়েক মিনিটের মধ্যে এগোলেই ফেলুর মোড়।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল। বাঁধানো বটগাছের তলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে অনেক মানুষ। তাঁদেরই একজন নাজবুল শেখ। গত ২০ বছর ধরে ভিনরাজ্যের মাটিতেই লেখা রয়েছে তাঁর রুটির ঠিকানা। লকডাউনের সময় ফিরে এলেও, আনলক শুরু হতেই ফের পাড়ি দিয়েছিলেন অন্য রাজ্যে। ইদ উপলক্ষে ক’দিন আগেই ফিরে এসেছেন গ্রামের অন্যদের সঙ্গে, যাঁরা তাঁর সঙ্গেই ফিরে গিয়েছিলেন বিহারের সমস্তিপুরে কাজ করতে। ট্রেন নেই। তাই বাস ভাড়া করে ফিরেছেন। ক’দিন পরে ফের ফিরে যাবেন সেই কাজের জায়গায়। আসা যাওয়ার গাড়ি ভাড়া একেক জনের চার হাজার টাকা।

এক দিকে দুঃখ, অন্যদিকে স্বস্তি আরজিনার। ফের ভিন রাজ্যে কাজে চলে যাবেন স্বামী ইব্রাহিম।

আখরিগঞ্জ গ্রাম পঞ্চায়েতের অংশ হলেও বিদ্যুৎবিহীন, সরকারি সুযোগ সুবিধা থেকে অনেক দূরে থাকা চরের মানুষ রুজি রুটির জন্য দশকের পর দশক ধরে নির্ভরশীল ভিন রাজ্যের উপর। নাজবুলের বয়স এখন ৩৫। পনেরো বছর বয়সে দাদার হাত ধরে প্রথম পাড়ি দিয়েছিলেন ভিন রাজ্যে কাজ করতে। নাজবুলের কথাতেও ইব্রাহিমের সুর, ‘‘কার বা বিদেশ বিভুঁইয়ে গিয়ে পড়ে থাকতে ভাল লাগে বলুন। কিন্তু এখানে তো উপায় নেই। আমাদের জমি নেই। জমির মালিককে বিঘে প্রতি ৬ থেকে ৮ হাজার টাকা দিয়ে জমি চাষ করতে হয়। পাট আর কলাই ছাড়া কিছু হয় না। সেই টাকা দিয়ে তো বেঁচে থাকা যায় না।”

আরও পড়ুন: ২৪ ঘণ্টায় সংক্রমণের হার আট শতাংশের কম, সুস্থ ৪৪ হাজার

চরে পৌঁছনোর আগেই কথা হচ্ছিল শিবনগরের ইব্রাহিমের পড়শি টেবলু শেখের সঙ্গে। ইব্রাহিমের মতো অবস্থা হয়েছিল তাঁরও। লকডাউনে আটকে পড়েছিলেন ভিন রাজ্যে। স্ত্রী আর ভাই মিলে টাকা পাঠিয়ে বাড়ি ফেরানোর বন্দোবস্ত করেন। তিনি জানালেন, ‘‘বাড়ি ফেরা থেকে বেকার বসে আছি প্রায়। পঞ্চায়েতের ১০০ দিনের কাজও নেই। আশেপাশে বা কলকাতায় গিয়ে কাজ করব তাও নেই।” পাশের ব্লক ভগবানপুর ১ নম্বর। সেখানকার আসানপাড়ার বাসিন্দা লিয়াকত শেখ, আয়ূব শেখরা লকডাউনের আগেই গ্রামে ফিরে আসতে পেরেছিলেন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। লিয়াকত বলেন, ‘‘দিদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করলেন আমাদের মতো বাইরে কাজ করা শ্রমিকদের এখানে ১০০ দিনের কাজ দেওয়া হবে। কিন্তু কোথায় কাজ? পঞ্চায়েত সদস্য থেকে প্রধানের কাছে বার বার যাচ্ছি। কিন্তু আমাদের কাজ তিনি দিচ্ছেন না নানা অছিলায়।” আয়ূবের অভিযোগ, ‘‘যাদের পরিবারের অন্য রোজগার আছে তারাও দেখছি কাজ পাচ্ছে। অথচ আমরা কাজ না পেয়ে মাসের পর মাস বসে। আমাদের কোনও কাজ দিচ্ছে না প্রশাসন।” আখরিগঞ্জ গ্রাম পঞ্চায়েতের নির্বাচিত প্রতিনিধি সুন্দরা বিবি। পরিযায়ী শ্রমিকরা ১০০ দিনের কাজ কতটা পাচ্ছেন জানতে চাই তাঁর কাছে। তাঁর কথায়, ‘‘এখনও পর্যন্ত (এপ্রিল মাস থেকে) মোট ৩৬ দিনের কাজ হয়েছে। একেক জন ১৭-১৮ দিন করে কাজ পেয়েছেন।” কিন্তু এর বেশি কাজ নেই কেন? সুন্দরার কাছে জবাব মেলেনি।

কাজের হাহাকার। এ ভাবেই বসে সময় কাটছে নির্মলচরের শ্রমিকদের।

গত ১৪ বছর ধরে মুম্বইতে কাজ করছেন আসানপাড়ার লিয়াকত। ছেলেমেয়েকে যাতে তাঁর মতো দিন মজুরি করে খেতে না হয়, তাই সাধ্যমতো চেষ্টা করছেন লেখাপড়া করানোর। ভগবানগোলা টাউনের একটি বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করেছিলেন ছেলে ফারহাতকে। কিন্তু গত ৪ মাস স্কুলের মাইনে দিতে পারেননি। স্কুল বলে দিয়েছে, মাইনে দিতে না পারলে পরীক্ষা দিতে দেওয়া হবে না ক্লাস ৯-এর পড়়ুয়া ফারহাতকে। সেই টাকা জোগাড় করতে আশেপাশে রাজমিস্ত্রির কাজ করারও চেষ্টা করেছিলেন তিনি। কিন্তু ২০০ থেকে ২৫০ টাকার বেশি মজুরির কাজ নেই। তাও মেলেনি রোজ। গাড়ি ভাড়া, দিনের খাওয়ার পিছনে খরচ হয়ে গিয়েছে একশো টাকার বেশি। এখন লিয়াকত ঠিকাদারের দোরে দোরে ঘুরছেন দ্রুত ভিন রাজ্যে কাজ জোগাড় করে বাড়ি ছাড়তে।

জেলা প্রশাসনের এক কর্তা স্বীকার করেন— চিরাচরিত কাজের বাইরেও অন্য অনেক রকম কাজ ১০০ দিনের কাজের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে, ভিন রাজ্য থেকে কাজ হারিয়ে ফিরে আসা শ্রমিকদের কিছুটা কাজের জোগান দেওয়ার সরকারি নীতি অনেক জায়গাতেই বাস্তবায়িত করা যায়নি। একই সঙ্গে তাঁর দাবি, কাজের পরিমাণের থেকে কাজ চাওয়া মানুষের সংখ্যাটা অনেক বেশি।

আসিফরা জানালেন, ‘‘রাজ্যে রুজি-রুটির বন্দোবস্ত করতে না পেরে, লকডাউনে ফিরে আসা লাখ লাখ শ্রমিকের অনেকেই মরিয়া হয়ে ফিরে গিয়েছেন কাজের খোঁজে ভিন রাজ্যে। কেউ বাড়ির শেষ সম্বলটুকু বেচে বা বন্ধক রেখে জোগাড় করেছেন গাড়ি ভাড়ার টাকা।”কিন্তু ভিন রাজ্যে গিয়েও নতুন বিপদের মুখে পড়েছেন অনেকে। আসানপাড়ার রুবেল শেখের বাবার বয়স হয়েছে। গোটা পরিবারে বছর ২৫-এর রুবেলই একমাত্র রোজগেরে সদস্য। তাই লকডাউন শেষ হতেই কাজের খোঁজে গিয়েছিলেন উত্তরপ্রদেশে। কিন্তু সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দাদের বাধায় ১৫ দিন কাজ করেই ফিরে আসতে হয়েছে তাঁকে। যাতাযাত খরচ জুগিয়ে রোজগার হয়েছে সামান্যই।

মহিলাদের বিড়ি বেঁধে যে রোজগার হয় তা এখন বড় ভরসা সব পরিবারের।

শুধু ভিন রাজ্য নয়, আনলকের প্রথম পর্যায়ে কলকাতা বা আশেপাশে কাজ করতে এসেও ফিরে যেতে হয়েছে অনেককে। শিবনগরের বাসিন্দা জানসার আলি বারাসতে একটি মোবাইল সংস্থার হয়ে অপটিকাল ফাইবার কেবল বসানোর কাজ পেয়েছিলেন লকডাউন শেষ হওয়ার পর। কিন্তু কাজ শুরু হওয়ার কয়েক দিন পরেই স্থানীয়দের বাধায় ফিরে যেতে হয়। কাজ হারিয়ে বাড়ি ফিরে আসা জানসারের আক্ষেপ, ছেলেমেয়ের লেখাপড়াটা হয়ত এ বার শেষ হয়ে যাবে। একাদশ শ্রেণিতে পড়ে তাঁর ছেলে, মেয়ে দু’জনেই। গ্রামের স্কুলে অনলাইন ক্লাস হয় না। প্রাইভেট টিউশন ভরসা। কিন্তু তাও বন্ধ অর্থের অভাবে। নিজে নবম শ্রেণিতে স্কুলছুট হয়ে ভিন রাজ্যে পাড়ি দিয়েছিলেন জানসার। চেয়েছিলেন ছেলে আর মেয়েটা পড়ুক। কিন্তু সেই জানসারই এখন অন্য ভাবে ভাবতে বাধ্য হচ্ছেন— ‘‘এ ভাবে চললে ছেলেকে পড়া ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে হবে কাজে।”

এই জানসারদের সংখ্যাটা খুব কম নয়। জানসাররা জানেন, ভিন রাজ্যে কাজে গেলে লেখাপড়াটা বন্ধ হবে। কিন্তু বেকার হয়ে গ্রামে থাকলে জীবন নষ্ট হতে পারে সীমান্ত জুড়ে চলা বেআইনি কাজের চক্রে যুক্ত হয়ে। কথাটা মিথ্যে নয়, তা স্বীকার করেন জেলার এক শীর্ষ পুলিশ কর্তাও।

কাজের সন্ধানে ফের বেরিয়ে পড়ার ভাবনা গোটা গ্রামজুড়ে।

মুর্শিদাবাদ জেলা প্রশাসনের কর্তারাও জানেন, হাজারে হাজারে পরিযায়ী শ্রমিক করোনার আতঙ্ক কাটিয়ে ঝুঁকি নিয়েই পাড়ি দিচ্ছেন ভিন্ রাজ্যে কাজের খোঁজে। কর্তাদের একজন জানালেন, ‘‘শুধু আমাদের জেলা নয়। মালদহ, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুরের মতো বিভিন্ন জেলাতেই একই ছবি।”

আরও পড়ুন: একশো দিনের কাজের ‘অডিট’ করতে রাজ্যে আসছে দিল্লির দল

রাজ্য শ্রম দফতরের এক আধিকারিক, যিনি শ্রমিক কল্যাণ বিভাগের সঙ্গে যুক্ত, বলেন, ‘‘খুব কম করে হলেও এ রাজ্যের প্রায় ১৭ লাখ শ্রমিক কাজ করছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। তার একটা অংশ মাত্র ফিরে আসতে পেরেছিলেন লকডাউনের সময়ে। কিন্তু সেই সংখ্যার মানুষকে কাজ দিতে যে পরিমাণ কাজের সুযোগ দরকার তা এই লকডাউন বা মন্দার মধ্যে এই রাজ্যে নেই।” বাধ্য হয়ে ভিন রাজ্যেই ফিরে যাচ্ছেন সবাই।

তাই ইদ শেষ হতেই পাড়ায় পাড়ায় প্রস্তুতি তুঙ্গে। ফের ঘর ছাড়ার তোড়জোড়। পদ্মাপাড়ের ভিটের মায়া ত্যাগ করে রুটির খোঁজে ফের বোঁচকা বাঁধা শুরু ভিন্‌ রাজ্যে অনিশ্চিতের উদ্দেশে যাত্রার জন্য। কারণ, গাঁয়ের মাটি, পরিবার মনে শান্তি দিলেও, পেট মানে না। তাই করোনার ভীতি, লকডাউন সব প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে ফের ঘর ছাড়ার লাইন। বাঁচতে হবে তো!

ছবি: অসীম রায়চৌধুরী

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement