প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী। —ফাইল চিত্র।
পঞ্চায়েত ভোট থছেকে রসদ সংগ্রহ করে লোকসভা নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করার কথা দলের। সেই সময়েই দলের রাজনৈতিক অভিমুখের প্রশ্নে ফের বিভ্রান্তি বঙ্গ কংগ্রেসের অন্দরে! এ বারের বিভ্রান্তির কারণ লোকসভায় বিরোধী দলের নেতা ও প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর সাম্প্রতিক মন্তব্য।
পটনা ও বেঙ্গালুরুতে বিরোধী জোটের বৈঠকের পরেও অধীর বলে এসেছেন, বাংলায় তাঁদের লড়াই বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেস, দু’দলের বিরুদ্ধেই। ওই দুই দলের বিরুদ্ধে লড়াই করার বার্তা দিতেই ধূপগুড়ি বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে সিপিএম প্রার্থীকে সমর্থন করছে কংগ্রেস। কিন্তু এরই মধ্যে তৃণমূলের সঙ্গে বোঝাপড়ার সম্ভাবনা প্রসঙ্গে লোকসভায় বিরোধী দলের নেতা তথা প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির বক্তব্যে অন্য সুরের ইঙ্গিত ধরা পড়েছে। বাংলার শাসক দলের সঙ্গে বোঝাপড়ার সম্ভাবনা সরাসরি নাকচ না করে একটি সর্বভারতীয় চ্যানেলের অনুষ্ঠানে অধীর বলেছেন, রাজনীতি সম্ভাবনার শিল্প। একই সঙ্গে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, বাংলার রাজনীতি পুকুর আর দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নদীর মতো। এখন পুকুরের চেয়ে নদী নিয়েই বেশি মাথা ঘামাতে হচ্ছে। এ সবের জেরে প্রশ্ন উঠেছে, বামেদের সঙ্গে জোট এবং তৃণমূল সম্পর্কে ‘নরম অবস্থান’, দু’টো একসঙ্গেই কী ভাবে চলবে!
প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির অবস্থানকে অনুসরণ করেই সংবাদমাধ্যমের সামনে এবং সমাজমাধ্যমে তৃণমূলের বিরুদ্ধে তোপ দেগে চলেছিলেন রাজ্য দলের মুখপাত্রেরা। এখন স্বয়ং অধীরের মন্তব্যে অন্য ইঙ্গিত ধরা পড়ায় বিপাকে পড়েছেন তাঁদের অনেকেই! প্রকাশ্যে সকলে মুখ না খুললেও ঘরোয়া আলোচনায় তাঁদের অনেকেই কংগ্রেসের ‘দোলাচল’কে দোষ দিচ্ছেন। কেউ কেউ আবার ক্ষোভ গোপনও করছেন না। প্রদেশ কংগ্রেসের মুখপাত্র ও আইনজীবী-নেতা কৌস্তভ বাগচী যেমন সোমবার মন্তব্য করেছেন, ‘‘পুকুর, নদী বুঝি না! দিল্লির স্বার্থে আর গিনিপিগ হতে রাজি নই। তৃণমূল আমাদের চোখে চোর ছিল, আছে ও থাকবে! তৃণমূল আমাদের চোখে গণতন্ত্রের হত্যাকারী ছিল, আছে এবং থাকবে।’’
লোকসভায় অনাস্থা বিতর্কের উপরে বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কংগ্রেসকে খোঁচা দিতে অধীরকে উপলক্ষ করেই বলেছিলেন, লোকসভায় বৃহত্তম বিরোধী দলের নেতার নাম অনাস্থা আলোচনায় বক্তা-তালিকায় থাকে না, কলকাতা থেকে ফোন এলে তাঁকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার কথাও ভাবা হয়! তার পরেই প্রদেশ কংগ্রেসের আর এক মুখপাত্র সুমন রায়চৌধুরী দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে খোলা চিঠি লিখে তোপ দেগেছিলেন, মোদী যে এমন কটাক্ষ করতে পেরেছেন, তার দায় তাঁদেরই নিতে হবে। বাংলায় তৃণমূলের অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন কংগ্রেস কর্মীরা। সেই কর্মীদের আর কত কিছু সহ্য করতে হবে? যে প্রদেশ সভাপতির লড়াইকে সামনে রেখে সুমনদের এমন বক্তব্য, সেই অধীরই ‘সম্ভাবনার শিল্পে’র তত্ত্ব দেওয়ায় গোটা পরিস্থিতিই বাংলায় দলের কাছে অস্বস্তিকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। আরও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা, অধীর যখন দিল্লিতে বসে তৃণমূল সম্পর্কে কড়া অবস্থান মুলতুবি রাখতে চেয়েছেন, তার দু’দিনের মধ্যে কলকাতায় এ দিন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্পষ্ট করে দিয়েছেন, বাংলায় ‘ইন্ডিয়া’ বলতে তৃণমূলকেই তাঁরা বোঝাচ্ছেন এবং বিজেপি-বিরোধী সব ভোট তৃণমূলকেই দিতে আবেদন জানাচ্ছেন। যার প্রেক্ষিতে সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীর বক্তব্য, ‘‘আমরা বারবারই বলছি, বিজেপি-বিরোধী জোটে তৃণমূল দায়ে পড়ে এসেছে এবং যে কোনও দিন বেরিয়ে যাবে! তার ইঙ্গিতই ধরা পড়ছে!’’ রাজনৈতিক শিবিরের একাংশের প্রশ্ন, মমতার মন্তব্যের পরে আর তৃণমূল সম্পর্কে কংগ্রেসের ‘সুর নরমে’র বাস্তবিক অর্থ কিছু থাকে কি?
কংগ্রেস নেতৃত্বের একাংশ মনে করিয়ে দিচ্ছেন, কৌস্তভ-সুমনেরা দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের দিকে আঙুল তুললেও ইতিহাস সেই দাবিকে সমর্থন করছে না। অতীতে ২০০১, ২০০৯ বা ২০১১ সালে তৃণমূলের সঙ্গে কংগ্রেসের জোট হয়েছিল রাজ্যের কংগ্রেস নেতৃত্ব সেই মর্মে সক্রিয় হয়েছিলেন বলেই। আবার ২০১৬ বা ২০২১ সালে বামেদের সঙ্গে সমঝোতা হয়েছিল প্রদেশ কংগ্রেস চেয়েছিল বলেই। রাজ্য দলের ইচ্ছার বাইরে গিয়ে হাই কম্যান্ড কিছু চাপিয়ে দেয়, এমন অভিযোগ ঠিক নয় বলেই ওই নেতাদের মত।