জিটিএ-র সদর দফতরে বিমল গুরুঙ্গ। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক।
পাহাড়-সমতলে একটা কথা চালু রয়েছে— মমতা-বিমলের সম্পর্ক বরাবরই অম্লমধুর। মুখ্যমন্ত্রীকে কখনও মায়ের সঙ্গে তুলনা করেছেন বিমল গুরুঙ্গ, কখনও বলেছেন অপদেবী। শুক্রবার সেই সম্পর্কের আর একটি ছবি দেখল পাহাড়। গুরুঙ্গের খাসতালুক সিংমারিতে সভা করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখানকার নর্থ পয়েন্ট স্কুলের মাঠে সরকারি অনুষ্ঠানে দাঁড়িয়ে প্রকারান্তরে বার্তা দিলেন মোর্চাকে। বললেন, ‘‘যাঁরা ঝগড়া করতে চান, তাঁদের বলছি ও সব ছেড়ে উন্নয়নে মন দিন। পাহাড়ের সব সম্প্রদায়ের মানুষ তাই চান। তাঁদের আর্জিকে মর্যাদা দিয়েই আমরা এগোচ্ছি।’’
এই অনুষ্ঠান যখন হচ্ছে, সিংমারিতে তখন অঘোষিত বন্ধ। সব দোকানপাটের ঝাঁপ বন্ধ। যা দেখে ক্ষুব্ধ মমতার মন্তব্য, ‘‘এ সব বন্ধ, অশান্তি পাহাড়ের মানুষ যে পছন্দ করেন না, তা অতীতে বুঝিয়ে দিয়েছেন। ফের বুঝিয়ে দেবেন।’’ এবং কিছুটা হতাশ গলায় উবাচ— ‘‘আমি এই এলাকাকে সুইৎজারল্যান্ড বানাতে চাই। কিন্তু টানা ঝগড়া করলে কোনও কিছুই হবে না।’’
তত ক্ষণে অনুষ্ঠান মঞ্চ থেকে অবশ্য গুরুঙ্গকে পাল্টা জবাব দেওয়া হয়ে গিয়েছে মমতার, আরও দু’টি উন্নয়ন বোর্ড গঠনের কথা ঘোষণার মাধ্যমে। এমনকী, সংখ্যালঘুদের জন্য আরও একটি উন্নয়ন পর্ষদ গড়া যায় কি না, তা-ও ভেবে দেখবেন বলে জানিয়েছেন।
আধ ঘণ্টার মধ্যে আবার এর জবাব দিয়ে ফেলেছেন গুরুঙ্গ। বলেছেন, ‘‘উনি একের পর এক বোর্ড গড়ছেন। তাতে কিছু মানুষের লাভ হচ্ছে!’’ বলেছেন, ‘‘যতই জাতি বিভাজনের চেষ্টা হোক, গোর্খা জাতিসত্তার অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে আমরাই সবাইকে পাশে পাব।’’
সম্পর্কের টানাপড়েন অনেক দিনই। ২০০৯ সালে মোর্চার সমর্থনে দার্জিলিং লোকসভা আসন থেকে জিতেছিলেন বিজেপি প্রার্থী যশোবন্ত সিংহ। দু’বছর পরে বিধানসভা ভোটে পাহাড়ে নিজেদের প্রার্থী দিলেও রাজ্যের অন্যত্র কংগ্রেস-তৃণমূল জোটকে সমর্থন করেছিল মোর্চা।
সম্পর্কের অবনতি হয় ২০১৩ সালের গোড়ায়। তেলঙ্গানা রাজ্য গঠনের সময় ফের গোর্খাল্যান্ড নিয়ে আন্দোলন শুরু করে মোর্চা। জবাবে ম্যালের সভায় দাঁড়িয়ে মমতা বলেছিলেন, ‘‘আমি কিন্তু রাফ অ্যান্ড টাফ!’’ নতুন করে ঠোকাঠুকি লাগে মমতা-গুরুঙ্গের।
এর এক বছরের পরে, ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে আবার বিজেপিকে সমর্থন করেন গুরুঙ্গরা। এর মধ্যে ঘটে গিয়েছে মদন তামাঙ্গ হত্যাকাণ্ড। এই খুনের অন্যতম প্রধান অভিযুক্ত নিকল তামাঙ্গ সিআইডি-র হাত থেকে উধাও হয়ে যান। তবে মামলাটি নিয়ে যথেষ্টই চাপে রয়েছেন মোর্চা নেতৃত্ব। চার্জশিটে নাম রয়েছে বিমল গুরুঙ্গ, তাঁর স্ত্রী আশা গুরুঙ্গ-সহ গোটা মোর্চা নেতৃত্বেরই। একটা সময় বিভিন্ন ফৌজদারি মামলায় জিটিএ-র প্রায় সব কর্মকর্তাও কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন।
বিমলের সঙ্গে তখন মমতার সম্পর্ক তলানিতে। এর মধ্যেই মোর্চার তৎকালীন বিধায়ক হরকাবাহাদুর ছেত্রীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে মুখ্যমন্ত্রীর। প্রশাসনের একটি সূত্রের বক্তব্য, হরকা দীর্ঘদিন সেতুবন্ধনের কাজ করেছেন মমতা এবং মোর্চা নেতৃত্বের মধ্যে। তার ফলেই এক দিন নবান্নয় আসেন গুরুঙ্গ। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পরে বেরিয়ে বলেন, উনি আমাদের মায়ের মতো।
সম্পর্কের অবনতি ঘটলে সেই মা-ই আবার পরে বদলে যান ‘অপদেবী’তে। তৃণমূলের একটি সূত্রের বক্তব্য, পাহাড়ে বিভিন্ন উন্নয়ন পর্ষদ গড়ে যেমন মোর্চার একাধিপত্য খর্ব করতে চেয়েছেন মমতা, উল্টো দিকে গুরুঙ্গ আবার বেগতিক দেখলেই গোর্খাল্যান্ডের দাবি তুলে হাওয়া গরম করার চেষ্টা করেছেন। জিটিএ চুক্তিতে গোর্খাল্যান্ড কথাটা রাখা হলেও পৃথক রাজ্যের দাবি মানেননি মমতা। তাই নিয়েও কম ক্ষোভ নেই মোর্চার।
পাহাড়ের অনেকেই বলছেন, মমতা তো এ বার বিভাজনের সঙ্গে দান খয়রাতির খাতাও খুলেছেন। এ দিন চারশোর বেশি ক্লাবকে ২৫ হাজার টাকা করে অনুদান থেকে শুরু করে পুরস্কার হিসেবে বিলোনো হয়েছে দেদার কম্বল, এলইডি টিভি, এমনকী মোটরবাইক-স্কুটিও। হরকার সঙ্গে সমঝোতার পথও প্রশস্ত করার চেষ্টা করছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। এই অবস্থায় শুধু প্রতীকী বন্ধ দেখিয়ে যে চলবে না, সেটা বিমলও ভালই বোঝেন। মুখে বলেছেন, ‘‘এ সব খয়রাতির মানে পাহাড়ের সবাই বোঝেন। এ সব করে পাহাড়ের মানুষের মন পাওয়া যাবে না।’’ কিন্তু দলীয় আলোচনায় গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন নিয়ে সুর চড়ানোরই কথা হয়েছে। যার জবাবে তৃণমূলকে বলতেই হবে, বাংলা ভাগ হতে দেব না! আর হরকা? মোর্চারই একটি অংশ বলছে, গুরুঙ্গের সঙ্গে টক্কর দিতে গেলে গোর্খাল্যান্ড প্রসঙ্গ তুললেই হবে হরকাকে। না হলে পাহাড়ের আবেগ তিনি ধরতে পারবেন না।
মমতাও গুরুঙ্গের এই কৌশল বিলক্ষণ জানেন। তাই আরও দু’টি বোর্ড তৈরির ঘোষণা করেই ক্ষান্ত হননি। পাহাড়ে যাতে আর আগুন না জ্বলে, সে জন্য সাবধান করেছেন। তরুণ প্রজন্মকে উন্নয়নের কথা বলে কাছে টানতে চেয়েছেন। সেই প্রসঙ্গে জিটিএ-র ‘অকর্মণ্যতা’ তুলে ধরারও চেষ্টা করেছেন।
তবে সিংমারির দাজু (গুরুঙ্গ) এ সবের উপরেই খেলেছেন অন্য একটি চাল। বলেছেন, ‘‘সিপিএম-কংগ্রেস কাছাকাছি আসছে বলে শুনছি। আমরাও ভাবছি। আগামী দিনে সব স্পষ্ট হয়ে যাবে।’’ শুধু পাহাড়ের তিনটি আসন নয়, সমতলে যে ১২টি আসনে কিছুটা হলেও তাঁদের গুরুত্ব আছে, সেগুলিতেও তৃণমূলকে বেগ দেওয়ার ইঙ্গিত আগাম দিয়ে রাখলেন গুরুঙ্গ।
বাকিটা? সময় বলবে, বলছেন গোর্খা লিগের এক নেতা। তাঁর কথায়, ‘‘তিস্তা দিয়ে অনেক জল বয়ে যাওয়া তো এখনও বাকি!’’