—প্রতীকী চিত্র।
রবিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন। তা সত্ত্বেও ডেঙ্গি পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন রাজ্য প্রশাসন জরুরি বৈঠক করেছে। জারি হয়েছে একাধিক নির্দেশিকা। কিন্তু রাজ্যে এখনও পর্যন্ত মোট কত জন ডেঙ্গিতে আক্রান্ত, সেই পরিসংখ্যান কিছুতেই সামনে আনছে না প্রশাসন। কেন? মানুষকে যদি সচেতন করতেই হয়, তা হলে এত রাখঢাক কিসের— ফের উঠছে সেই প্রশ্ন।
কোনও এক অদৃশ্য নিষেধাজ্ঞার জেরে চলতি মরসুমে, অর্থাৎ গত জানুয়ারি থেকে এখনও পর্যন্ত রাজ্যে কত জন মশাবাহিত এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন বা মারা গিয়েছেন— সে সম্পর্কিত কোনও তথ্য প্রকাশ্যে আনতে নারাজ স্বাস্থ্য দফতর। সূত্রের খবর, গোপনীয়তার এমনই কড়াকড়ি যে, গত বছরের মতো এ বার সামগ্রিক পরিসংখ্যান পাঠানো হচ্ছে না জেলার স্বাস্থ্য আধিকারিকদের কাছেও। স্বাস্থ্যকর্তারাও অনেকে মুখ খুলতে নারাজ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্তা বলেন, ‘‘তথ্য গোপন করা হচ্ছে, তেমন নয়। ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, আমরাও চেষ্টা করছি। সবই প্রশাসনের শীর্ষ স্তরে জানানো হচ্ছে।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘ডেঙ্গির জন্য পৃথক ওয়েবসাইট নেই। কোভিডের জন্য জনস্বাস্থ্য বিভাগের একটি পৃথক প্ল্যাটফর্ম ছিল। সেখানে পরিসংখ্যান মিলছিল।’’
‘অ্যাসোসিয়েশন অব হেলথ সার্ভিস ডক্টর্স’-এর সাধারণ সম্পাদক মানস গুমটা বলেন, ‘‘তথ্য গোপন করাই এখন আমাদের রাজ্যের জনস্বাস্থ্যের প্রোটোকল। রোগের প্রকোপের তথ্য, পরিসংখ্যান জানা না গেলে মানুষ সচেতন হবেন কী করে? কতটা বিপদ, বুঝবেন কী ভাবে? জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞেরা কাজ করবেন কী করে?’’ চলতি বছরে রাজ্যে কোনও ভাবেই ডেঙ্গির প্রকৃত চিত্র জানানো হচ্ছে না। সরকারি তরফে তো বটেই, এমনকি তথ্য গোপন করার প্রবণতাও মারাত্মক ভাবে দেখা যাচ্ছে বলে অভিযোগ। ডেথ সার্টিফিকেটে বা বেসরকারি পরীক্ষাগারে রক্ত পরীক্ষার রিপোর্টে ডেঙ্গি না লেখার জন্য বহু জায়গায় অলিখিত নির্দেশ রয়েছে বলেও অভিযোগ উঠছে। মানসের আরও দাবি, ‘‘ডেঙ্গি এ রাজ্যে প্রতি বছরের সমস্যা। অথচ সারা বছর ঘুমিয়ে থেকে, তার পরে আগুন লাগলে পুরসভাগুলি দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। তার উপরে তথ্য গোপন করা মানে মানুষকে আরও বিপদের মধ্যে ঠেলে দেওয়া। ফলে আরও অনেক ডেঙ্গি-মৃত্যু দেখতে হবে।’’
সূত্রের খবর, গত বছরের তুলনায় এ বারের পরিস্থিতি আরও জটিল। বেসরকারি সূত্রের খবর, গত জানুয়ারি থেকে রাজ্যে মোট ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার! সেখানে গত বছর অক্টোবরের প্রথমে রাজ্যে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল কমবেশি ২৪ হাজার। আবার বেসরকারি সূত্রের খবর অনুযায়ী, মৃতের সংখ্যা ৩১ হলেও সরকারি মতে সেই সংখ্যা মাত্র তিন! কারণ এখানেও কোভিডের মতো কোমর্বিডিটির তত্ত্ব দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে প্রশাসন।
জনস্বাস্থ্য কর্মী তথা চিকিৎসক পুণ্যব্রত গুণ বলেন, ‘‘অসংক্রামক অসুখে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। তখন কোনও সংক্রমণ হলে রোগী সঙ্কটজনক হন। এটা স্বাভাবিক হলেও কোমর্বিডিটি বা অসংক্রামক রোগের কারণ দেখিয়ে ডেঙ্গি-মৃত্যুকে আড়াল করা ঠিক নয়।’’ তিনি মনে করেন, ডেঙ্গির প্রকৃত তথ্যই একমাত্র ঠিক পদক্ষেপের দিশা দেখাতে পারে। কিন্তু সরকার ভাবছে, ডেঙ্গিতে মৃত্যু মেনে নিলে তাদের ব্যর্থতা প্রকাশ পাবে। তাই ২০১৮ সালেও এ ভাবেই ডেঙ্গির তথ্য গোপনের মারাত্মক প্রবণতা দেখা গিয়েছিল বলেও দাবি তাঁর।
রবিবার রাজ্য প্রশাসনের বৈঠকেও ডেঙ্গি প্রবণ জেলা হিসাবে উঠে এসেছে উত্তর ২৪ পরগনা, হাওড়া, হুগলি, নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, মালদহ, দক্ষিণ ২৪ পরগনার নাম। সূত্রের খবর, গত জানুয়ারি থেকে ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত উত্তর ২৪ পরগনায় ৬৯২৫ জন, নদিয়ায় ৩৯৬৯ জন, কলকাতায় ৩৪১৬ জন, মুর্শিদাবাদে ৩৪০৭ জন, হুগলিতে ২৬০০ জন, হাওড়ায় ১৪৬৮ জন, ঝাড়গ্রামে ১১১৭ জন এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনায় ১০১০ জন ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়েছেন। বাকি জেলাগুলিতেও কম-বেশি আক্রান্ত রয়েছে। প্রতি সপ্তাহেই ৩ থেকে ৫ হাজার করে ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।