এ রকমই অবস্থা ভাগীরথী এক্সপ্রেসের একটি কামরার। মঙ্গলবার শিয়ালদহে। — নিজস্ব চিত্র
• ভিড়ে ভিড়াক্কার শিয়ালদহ স্টেশন। বাইরে তৃণমূলের ক্যাম্প অফিস। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সেই ক্যাম্প অফিসে দাঁড়ানো নেতাদের সামনে দলীয় কর্মীদের একটাই আবেদন, ‘দয়া করে উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেসে উঠিয়ে দিন।’
• হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে মিথিলা এক্সপ্রেসের সংরক্ষিত কামরায় উঠতে গিয়ে খিদিরপুরবাসী দুই ভাই মহম্মদ আজিম এবং মহম্মদ রফিকের চোখ উঠে গেল কপালে। কামরার দরজা আটকে বসে রয়েছেন তৃণমূল-সমর্থকেরা! তাঁদের সরতে বলায় বেধে গেল বচসা। রেল পুলিশকে ধারেকাছে দেখা গেল না।
দু’টো ছবির মধ্যে মিল আর অমিল আছে জড়াজড়ি করে। মিল মানে দু’দলই তখন যাত্রী। যে-ভাবেই হোক, ট্রেনে উঠতে মরিয়া দু’পক্ষই। এবং কেউই সহজ, স্বাভাবিক ভাবে ট্রেনে উঠতে পারছেন না। কেননা ঠাঁই-নেই-ঠাঁই-নেই অবস্থা।
আর অমিল বলতে এক দল টিকিট কাটা সাধারণ যাত্রী। অন্য দল ২১ জুলাইয়ের সমাবেশে আসা তৃণমূল-সমর্থক। মিল এবং অমিলের দ্বন্দ্বটাও স্পষ্ট। দু’দলই যাত্রী। তবু এক দল যাত্রী আগে থেকে আসন সংরক্ষণ করেও ট্রেনে উঠতে পারছেন না অন্য দলের বাধায়। ধর্মতলার সভা-ফেরত সেই অন্য দলের যাত্রীরা মরিয়া, সংরক্ষিত কামরা হোক বা না-হোক, বাড়ি ফেরার জন্য উঠতেই হবে ট্রেনে।
মঙ্গলবার বিকেল থেকে বেশি রাত পর্যন্ত এই ছবিটাই দেখা গিয়েছে হাওড়া আর শিয়ালদহ স্টেশনে। ধারাচিত্রের মতো। এমনটা যে হতে পারে, পূর্বাভাস ছিলই। আমজনতার অসুবিধে হতে পারে বলে আগেভাগে ক্ষমা চেয়ে রেখেছিলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই। কিন্তু তাতে দূরের ট্রেনের সাধারণ যাত্রী বা তাঁর দলের বাড়িমুখো কর্মী-সমর্থকদের কিছুমাত্র সুরাহা যে হয়নি, মহানগরের দুই মহাস্টেশনই তার প্রমাণ মিলেছে রাত পর্যন্ত।
বিকেল থেকেই শিয়ালদহ স্টেশন চত্বরে ক্যাম্প অফিস খুলে বসেছিল উত্তর কলকাতা জেলা তৃণমূল কংগ্রেস। সেখানে ছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, গৌতম দেব, সাংসদ সুব্রত বক্সী প্রমুখ। তাঁরা তখন ‘স্বেচ্ছাসেবক’-এর ভূমিকায়। তাঁদের স্বগতোক্তি, ‘‘উত্তরবঙ্গের ভিড়টাই বেশি।’’ এতই বেশি যে, দলের কর্মীদের অনুরোধ করতে বাধ্য হচ্ছেন, ‘‘আজ যেতে না-পারলে কাল যাবেন। আমরা ব্যবস্থা করে দেব। না-হলে রাতে কলকাতা স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠবেন। সেখান থেকে স্পেশ্যাল ট্রেন ছাড়বে। আমরা ট্রাকে তুলে ওখানে পাঠিয়ে দেব।’’ মালদহ, কোচবিহার, মুর্শিদাবাদের ট্রেন কখন কোন প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাড়বে— মাইকে বারবার ঘোষণা করতে দেখা যায় দুই মন্ত্রীকে।
এরই মধ্যে দেখা গেল, এক দল যুবক হন্যে হয়ে ধর্মতলার সমাবেশে যোগদানের ব্যাজ (মুখ্যমন্ত্রীর ছবি দেওয়া) খুঁজছেন। কারণ কী? এক যুবক জানালেন, তাঁদের কাছে ফেরার টিকিট নেই। ওই ব্যাজটাই যে তাঁদের বাড়ি ফেরার ‘ট্রেনের টিকিট’!
আট নম্বর প্ল্যাটফর্মে সন্ধ্যা ৬টার আগেই ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে ভাগীরথী এক্সপ্রেস। তিলধারণের জায়গা নেই তাতেও। নাকাশিপাড়ার বিধায়ক কল্লোল খাঁ সামনে দাঁড়িয়ে। দেখভাল করছেন, দলের কোনও কর্মী-সমর্থক যেন ট্রেনের কামরায় না-ঝোলেন।
৯, ৯এ, ৯বি প্ল্যাটফর্মও তখন জনসভার চেহারা নিয়েছে। মিরিকের নেতা অনিল ছেত্রী জনা পঞ্চাশ কর্মী নিয়ে বসে আছেন। কোন ট্রেনে বাড়ি ফিরবেন, জানেন না। কিন্তু যে-ভাবেই হোক, ফিরতে তো হবেই। অনিল জানালেন, সমাবেশে আসার সময় ট্রেনে তুলে দিয়েছিলেন অন্য নেতারা। কিন্তু ফেরার টিকিট তাঁদের কাছে নেই।
এরই ফাঁকে রেলের ঘোষণা: উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস ৭টা ৩৫ মিনিটে ৯বি প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাড়বে। ৭টারও আগে ঢুকে গেল ট্রেন। পড়ি-কি-মরি করে ছুটলেন দলীয় কর্মী-সমর্থকেরা। বাতানুকূল তিনটি কামরা বাদে সংরক্ষিত, অসংরক্ষিত সব কামরা ভরে গেল নিমেষে। ওই ট্রেনের টিকিট পরীক্ষক দেবকুমার গঙ্গোপাধ্যায় ঘামতে ঘামতে এগিয়ে চললেন ইঞ্জিনের দিকে। জানালেন, তিনি নিজে কী করে ট্রেন উঠবেন, সেটাই বুঝতে পারছেন না! টিকিট কেটে আসা যাত্রীদের ঠাঁই দেবেন কী ভাবে? দেবকুমারবাবুর পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘বর্ধমান কোটায় যাঁদের ওঠার কথা, তাঁরা কী করে উঠবেন বলতে পারেন?’’
ট্রেনে উঠতে না-পেরে যাঁরা দিশাহারা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, তাঁদের এক জনকে প্রশ্ন করা হল, কোথায় যাবেন? বললেন, ‘‘যাব কোচবিহার। নেতা হিমঘরে কাজ দিয়েছে। তাই দিদির ‘মেন’ মিছিলে এসেছিলাম। না-এলে চাকরি থাকবে না। কিন্তু কী করে ফিরব, জানি না!’’
এরই ফাঁকে দেখা গেল, রোগাপাতলা এক যুবককে চড়থাপ্পড় মারছেন উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেসে উঠে পড়া এক দল যুবক। দলের এক নেতা ওই যুবকদের বলছেন, ‘‘ওর হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে নে। আজ ছেড়ে দে ওকে।’’ কী ব্যাপার? জানা গেল, যুবকটি নাকি এক মহিলার ব্যাগ টেনে নিয়েছিল। তাই মার। তবে নেতাদের হস্তক্ষেপে শেষ পর্যন্ত রেহাই।
টিকিট কাটা সব যাত্রীর অবশ্য সুরাহা হয়নি। ছাড়তে দেরি না-হলেও উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস শেষ পর্যন্ত রওনা দেয় অসংরক্ষিত ট্রেন হিসেবে।
কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেসের অবস্থা গোড়ায় তুলনামূলক ভাবে ভাল ছিল। কারণ, আরপিএফ মোতায়েন ছিল প্রায় সব কামরার দরজাতেই। ফলে টিকিটধারী যাত্রীরা উঠতে পেরেছেন। কিন্তু ট্রেন ছাড়ার সময় আসন্ন হয়ে আসতেই ছবিটা বদলে গেল। ঝড়ের মতো জনতা আছড়ে পড়ল প্রতিটি কামরায়। হাল ছেড়ে দিল আরপিএফ। ট্রেন অবশ্য ছাড়ল ঠিক সময়েই।
অন্যান্য ট্রেনেরও একই অবস্থা। বেলা সাড়ে ৩টের পর থেকেই হাওড়া স্টেশন কার্যত তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের দখলে চলে যায়। সকলেরই বুকে তৃণমূলের ব্যাজ। মাথায় দলীয় চিহ্ন দেওয়া ফেট্টি। হাতে দলীয় পতাকা। ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিতে দিতে এক-একটি দল স্টেশনে ঢুকছে আর দূরপাল্লার ট্রেন ঢোকা মাত্র হুড়মুড়িয়ে উঠে পড়ছে। মিথিলা থেকে শুরু করে কোলফিল্ড, স্টিল, কবিগুরু এক্সপ্রেস— সব ট্রেনেই এক ছবি। অনেক ট্রেনের যাত্রীরা সংরক্ষিত কামরায় উঠতে না-পেরে বিক্ষোভও দেখান। রেল পুলিশ থাকলেও তারা নীরব দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে ছিল বলে অভিযোগ।
তৃণমূলের ব্যাজধারীদের জিজ্ঞাসা করা হল, ট্রেনের টিকিট আছে তো?
বুকে তৃণমূলের ব্যাজ দেখিয়ে সমবেত জবাব: ‘‘দিদির সভা থেকে ফিরছি। এটাই আমাদের টিকিট!’’