প্রতি বারের মতো এ বারও আলিপুরদুয়ারের পুজোয় সামিল হয়েছে দুই সম্প্রদায়। পুজো কমিটির বৈঠকের ফাইল চিত্র।
পিছিয়ে যাওয়া যাক ৩২৩ বছর।
কথিত আছে, মা দুর্গার স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন মালদহের নুরপুরের জমিদার জহুর খাঁ! নদীতে ভেসে আসা কাঠামো তুলে এনে তাঁর উদ্যোগে শুরু হল পুজো। রতুয়া বাজারের সেই পুজো এখন সর্বজনীন।
ইতিহাস থেকে চলে আসা যাক বর্তমানে। দিন কয়েক আগের কথা।
এ বার মহরমের তাজিয়া নিয়ে রাস্তায় মহড়ার জন্য জলপাইগুড়িতে দশমীর দিন বিকেল চারটের মধ্যে পুজোর বিসর্জন সেরে ফেলার প্রস্তাব দিয়েছিল প্রশাসন। কিন্তু প্রশাসনিক বৈঠকে মহরম কমিটির প্রতিনিধিরাই প্রশ্ন তোলেন, মহরমের জন্য পুজোর বিসর্জনের সময় বেঁধে দেওয়া হবে কেন? তাঁরা দাবি করেন, দুই অনুষ্ঠান একই সঙ্গে চলুক। পুজো কমিটির কর্মকর্তারাও তাঁদের সঙ্গে সুর মেলান। গত ১১ অক্টোবর দিনভর বিসর্জন চলেছে জলপাইগুড়িতে। মহরমের মহড়াও হয়েছে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে।
দুর্গাপুজো এবং মহরমকে ঘিরে সম্প্রীতির এই নজির ছড়ানো রয়েছে জেলা থেকে জেলায়।
২০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে হিন্দু ও মুসলিমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মণ্ডপে প্রতিমা আনা থেকে অঞ্জলি, মেলা, বিসর্জন— সব কিছুই করে চলেছেন উত্তর দিনাজপুরের গোয়ালপোখর-২ ব্লকের পুজোয়। নবমীর দুপুরে সেখানে দুই সম্প্রদায়ের এক হাজারেরও বেশি মানুষ পুজো দেন। পুজো কমিটির সদস্যরা হাসিমুখে জানালেন, ১৮১৩-তে এক পিরবাবা এবং পুরোহিত পাটকাঠিকে দুর্গারূপে প্রতিষ্ঠা করে পুজো শুরু করেন! প্রথা অনুযায়ী প্রতি বছর লক্ষ্মীপুজোর আগের দিন এলাকার হিন্দু-মুসলিমরা এক হয়ে মন্দির সংলগ্ন একটি পুকুরে প্রতিমা বিসর্জন দেন!
মালদহের রতুয়ায় আব্দুস সাত্তার, বেলালুদ্দিন আহমেদ-দের সঙ্গে সঙ্গে মহরমের লাঠি খেলেন উজ্জ্বল দাস, রাজু রায়রা। হাসান-হোসেনের কথা বলে ‘ঝার্নি’ গান করেন। মেদিনীপুর আলম কমিটির মহরমের মিছিলে সব ধর্মের মানুষই পা মেলান। এ বার মিছিল যখন নিমতলা চকের কাছে পৌঁছয়, তখন স্থানীয় বটতলা চক সর্বজনীন দুর্গোৎসবের উদ্যোক্তারা মিছিলে সামিল লোকজনকে মিষ্টিমুখ করান। দুর্গাপুজো ও মহরমে সম্প্রীতি অক্ষুণ্ণ রাখতে বীরভূমের সিউড়ির কাটাবুনি যুবকল্যাণ কমিটি নামে একটি মহরম কমিটি তো এ বার দৃষ্টান্ত গড়েছে। শোভাযাত্রায় ছিল না কোনও তাজিয়া, নিশান, বাজনা। ছিল না লাঠি বা তরোয়াল খেলা। শুধুমাত্র শোক পালনেই মহরম সীমাবদ্ধ রেখে গোটা শহর ঘুরলেন কমিটি সদস্যরা। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল দুর্গাপুজো কমিটিগুলিও। মহরমের ‘মাতমে’ সামিল সদস্যদের জন্য পুজো কমিটির তরফে ছোলা-বাতাসা ও জল এগিয়ে দিতে দেখা যায় বহু জায়গায়।
সম্প্রীতির আর এক চিত্র দেখা গিয়েছে বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের দ্বারিকা গ্রামে। সেখানে দ্বারিকা সর্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটির বিজয়া সম্মিলনীতে পাত পেড়ে খেলেন হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ। ক্যানিঙের মিঠাখালি সর্বজনীন পুজোর আয়োজন করেন দুই সম্প্রদায়ের মানুষই। বিজয়া দশমীতে হুগলির পুড়শুড়ার খুশিগঞ্জ ফেরিঘাটে ‘নিরঞ্জন মেলা’ হয়ে ওঠে দুই সম্প্রদায়ের মিলনমেলা।
৫৯ বছর ধরে জাতধর্ম ভুলে আলিপুরদুয়ারের পাটকাপাড়া এলাকায় দুর্গাপুজো করে আসছেন দুই সম্প্রদায়ের মানুষ। পুজো কমিটির কোষাধ্যক্ষ মতিউর রহমান জানান, এখানে প্রায় ১০০ ঘর সংখ্যালঘু পরিবার রয়েছে। সকলেই দুর্গাপুজোর প্রস্তুতিতে সামিল হন। পুজোর চার দিন নানা অনুষ্ঠানেও যোগ দেন। তিনি বলেন, ‘‘এখানে সবাই মিলেমিশে থাকি। আমার ছেলে আনোয়ার রহমান অষ্টমীতে স্নান সেরে নিয়ম মেনে অঞ্জলি দেয়।” এলাকার দেবাশিস কুণ্ডু, বাবুয়া সাহারা জানালেন, তাঁরাও ঈদ উৎসবে সামিল হন।
সীমান্তের ও পারে বাংলাদেশে শত উস্কানির মধ্যেও এ বার সম্প্রীতির আবহে পুজো ও মহরম পালন করেছেন মানুষ। শান্তিতে উৎসব পালনের সম্পূর্ণ কৃতিত্ব দুই সম্প্রদায়ের সচেতন মানুষকে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। হাজার হাজার পুজো কমিটিতে অন্য বছরের মতো এ বারও ছিলেন মুসলিম সম্প্রদায়ের অজস্র মানুষ। চার দিনের দুর্গা পুজো সুষ্ঠু ভাবে সম্পাদন করার পরে মণ্ডপে মণ্ডপে লক্ষ্মীপুজোর ভোগ খেতে ভিড় জমিয়েছেন সব ধর্মের লোকজনই।
সম্প্রীতির এমন হাজারো কাহিনি বাংলার মুখে মুখে ফেরে। এবং সে কাহিনি শুধু দুর্গাপুজো বা মহরমেই আবদ্ধ নয়। কোচবিহারে রাসযাত্রায় বিশাল রাসমেলা হয় মদনমোহন বাড়ি ঘিরে। সেই রাসচক্র তৈরি করেন হরিণচওড়ার বাসিন্দা আলতাপ মিঞা। মালদহের ময়নায় ৩০০ বছরের প্রাচীন ‘বিষহরি ঠাকুরানি মেলা’য় পুজো দেন মুসলিমরা। এর সঙ্গে যোগ করা যাক দিনহাটার পুটিমারির ‘বুড়িমায়ের পুজো’। ১৩২ বছর আগে যে তিন বন্ধু মিলে ওই পুজো শুরু করেছিলেন, তাঁদের এক জনের নাম আসমত বক্সী। পুজো কমিটির সহ-সভাপতির নাম ফজলে রহমান। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিশিষ্ট জন, সকলে তাই এক বাক্যে বলেন, বিভেদ নয়। সম্প্রীতিই এ রাজ্যের অভিজ্ঞান। শিক্ষাবিদ মীরাতুন নাহারের কথায়, ‘সম্প্রীতিটাই আমাদের সংস্কৃতি।’’ গলা মেলালেন সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। বললেন, ‘‘এ রাজ্যে সম্প্রীতির বাতাবরণ চিরকাল অটুট।’’