এক জোট: সিএএ এবং এনআরসির বিরোধিতায় মানবশৃঙ্খল। প্রজাতন্ত্র দিবসের সকালে পার্ক সার্কাসে। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
প্রধানমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রীর অনুষ্ঠান, কুচকাওয়াজ শুধু নয় সৌহার্দ্য, সম্প্রীতির আবেগের ছোঁয়াচ রবিবার সত্যিই ছড়িয়ে গেল জনগণ মনে।
এমন প্রজাতন্ত্র দিবস শেষ কবে দেশ দেখেছে, মনে করতে পারছেন না অনেকেই।
শুধু লালকেল্লা বা রেড রোড প্রাঙ্গণ নয়— কলকাতার পার্ক সার্কাসের মাঠ, জাকারিয়া স্ট্রিট, খিদিরপুর, বেলগাছিয়াতেও রবিবার গড়ে উঠল এক-একটি ছোটবড় স্বদেশসৌধ। পাড়ায় পাড়ায় ‘বন্দে মাতরম’, ‘ভারতমাতা কি জয়’ ধ্বনিতে তেরঙা সাক্ষী রেখেই উঠে এল পিছনের সারিতে পড়ে থাকা অশ্রুত বহু স্বর। কলকাতা তেতে ছিল শ্যামবাজার থেকে গোলপার্ক জুড়ে সংবিধান রক্ষার মানববন্ধন নিয়েও।
আরও পড়ুন: সংবিধান রক্ষার ডাক মমতার, পথে বাম-কংগ্রেস
সাধারণত ২৬ জানুয়ারির ছুটি উপলক্ষে পাড়া, অফিসের বন্ধুদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে পরস্পরকে হাঁক দেওয়াই দস্তুর। এ বারও তার নড়চড় হয়নি। এ বারের সংযোজন বন্ধুরা মিলে ঠিক করা— গড়িয়াহাট না মানিকতলা কে কোথায় নির্দিষ্ট সময়ে কে কোথায় দাঁড়াবেন মানববন্ধনে।
শহরের একটি আন্তঃধর্ম মঞ্চ, ইউনাইটেড ইন্টারফেথ ফাউন্ডেশন ইন্ডিয়ার ডাকে হাতে হাত মেলানো মানুষের অভূতপূর্ব জোট জুড়ে দিয়েছিল শহরের ১১ কিলোমিটার। গোলপার্ক থেকে গড়িয়াহাট, বালিগঞ্জ ফাঁড়ি থেকে পার্ক সার্কাস, মল্লিকবাজার থেকে শিয়ালদহ পেরিয়ে পুরো শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড় পর্যন্ত মানুষের ঢল। এই উদ্যোগটির অন্যতম আহ্বায়ক সতনম অহলুওয়ালিয়ার দাবি, ‘‘যা মনে হচ্ছে অন্তত ৫০ হাজার লোক শহর জুড়ে হাতে হাত ধরে দাঁড়িয়েছিলেন। কোথাও কোথাও দুটো সারিতেও লোক দাঁড় করাতে হয়েছে।’’ জড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে নির্দিষ্ট সময়ে জাতীয় সঙ্গীত গাইবার সময়ে অনেকেরই চোখের কোণ চিকচিকিয়ে ওঠে।
এ দিনই শহরের প্রায় সব ক’টি মসজিদ কমিটির ডাকে তেরঙা উত্তোলনের অনুষ্ঠানও আলাদা ভাবে নজর কেড়েছে। চার্চ অব নর্থ ইন্ডিয়ার অন্তর্গত কলকাতা ডায়োসিসের ডাকে সব গির্জাতেই রবিবারের প্রার্থনা শেষে সংবিধানের প্রস্তাবনা অংশটুকু (প্রিঅ্যাম্বল) সম্মিলিত ভাবে পড়া হয়। একই রকম উদ্দীপনায় পথে নেমেছেন বিশেষ ভাবে সক্ষম তথা শারীরিক প্রতিবন্ধকতার শিকার মানুষজন। বালিগঞ্জ স্টেশনের কাছে প্রতিবন্ধীদের অধিকার নিয়ে সক্রিয় সংগঠনগুলির সম্মিলিত উদ্যোগেও একসঙ্গে সংবিধানের প্রিঅ্যাম্বল পড়া হয়েছে।
প্রজাতন্ত্র দিবসে দেশপূজার হিড়িক নতুন কিছু নয়। কিন্তু দেশে নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) এবং জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) ঘিরে প্রতিবাদের আবহে অনেকেই প্রজাতন্ত্র দিবসে একটি বার্তা দিতে চেয়েছেন। এ ভাবে পথে নেমে দলে দলে সংবিধান পাঠও কার্যত অভূতপূর্ব। জাতীয় পতাকা হাতে বা গালে তেরঙা এঁকে অনেকেই বোঝাতে চেয়েছেন, ধর্মীয় বিভাজন ঘটিয়ে মানুষে মানুষে ফাটল ধরানোর চেষ্টা হলে তাঁরা সংবিধানের আদর্শ রক্ষায় পথে নামতে পারেন।
স্বাধীনতার আগে ২৬ জানুয়ারি দিনটিকে ভাবী কালের পূর্ণ স্বরাজের স্বপ্নে ভরে পালন করার ডাক দিয়েছিল কংগ্রেস। এ বারের ২৬ জানুয়ারি সংবিধানের আদর্শ রক্ষায় মানুষের স্বতঃস্ফূর্ততায় উজ্জ্বল। অনেকের কাছেই যা দেশের ইতিহাসের অভিযাত্রায় এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়।