বামে-ডানে। (বাঁ দিক থেকে) বিমান বসু, সূর্যকান্ত মিশ্র, মঞ্জুকুমার মজুমদার এবং মানিক মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে পার্থ চট্টোপাধ্যায়। বুধবার মৌলালি যুব কেন্দ্রে আরএসপি-র প্রাক্তন রাজ্য সম্পাদক দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মরণসভায়। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।
ভোট-পর্বের সন্মুখ সমরে এখন একটু বিরতি। ফলপ্রকাশের আগে প্রতিটা দিন কাটছে উৎকণ্ঠায়। যেন নতুন করে ঝড় ওঠার আগে সাময়িক শান্তি! এই আবহেই প্রবীণ বাম নেতার স্মরণসভায় এক মঞ্চে দেখা গেল সিপিএম, তৃণমূল এবং বিজেপি নেতাদের। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু, বিধানসভার প্রাক্তন স্পিকার হাসিম আব্দুল হালিমের পরে এ বার প্রাক্তন মন্ত্রী দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মরণের মঞ্চ এক জায়গায় নিয়ে এল রাজ্য রাজনীতির যুযুধান সব শিবিরকে।
মৌলালি যুব কেন্দ্রের স্বল্প পরিসরে বুধবার আরএসপি-র প্রাক্তন রাজ্য সম্পাদক দেবব্রতবাবুর স্মরণসভায় উপচ়ে পড়েছিল ভিড়। জায়গা না পেয়ে প্রেক্ষাগৃহের মেঝেতে, বারান্দায়, দরজার বাইরে ঠাঁই নিয়েছিলেন প্রয়াত নেতার অনুরাগীরা। মঞ্চে তখন বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু, সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র, কংগ্রেসের দেবব্রত বসু ও ঋজু ঘোষাল, বিজেপি নেতা তপন ঘোষ, এসইউসি-র মানিক মুখোপাধ্যায়, পিডিএসের সমীর পূততুণ্ডের পাশাপাশিই সব বাম শরিক দলের নেতারা। একটু পরে অনুষ্ঠান চলাকালীন এসেছিলেন তৃণমূল নেতা পার্থ চট্টোপাধ্যায়। দলনেত্রীর নির্দেশে প্রয়াত বাম নেতার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে চলেও গিয়েছেন আগে। তবে তার মধ্যেই সর্বদল সমাহারের বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছে! দিনের শেষে যা তৃপ্তিই দিয়েছে আরএসপি-র রাজ্য সম্পাদক ক্ষিতি গোস্বামী বা বর্ষীয়ান নেতা মনোজ ভট্টাচার্যদের।
বামেদের সঙ্গে তাঁদের রাজনীতির ফারাকের কথাও এ দিন তোলেননি পার্থ। এক কালের কৃতী ছাত্র, ব্যবহারে বিশিষ্ট এবং রাজনীতিতে বিচক্ষণ দেবব্রতবাবুর স্মৃতিচারণ করে পার্থবাবু বরং বলেছেন, ‘‘জনদরদী এক নেতাকে হারিয়েছি। এর চেয়ে বড় ক্ষতি আর কী হতে পারে?’’ বিজেপি-র প্রতিনিধি তপনবাবু স্মরণসভার মঞ্চেই জানান, তাঁদের দলের রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ নিজেই এই অনুষ্ঠানে আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচির জন্য দিলীপবাবু আসতে না পারায় তাঁকে পাঠানো হয়েছে। প্রয়াত আরএসপি নেতাকে ‘উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক’ বলে উল্লেখ করেন তপনবাবু।
তবে স্মরণসভার গাম্ভীর্যের মধ্যেও এ দিন সঙ্ঘ পরিবারের রাজনীতিকে বিঁধতে ছাড়েনি বামেরা! আক্রমণের প্রসঙ্গ এসে পড়েছিল দেবব্রতবাবুর অতীত জীবনের সূত্রেই। ম্যাট্রিকুলেশন এবং ইন্টারমিডিয়েটে দুর্দান্ত ফলের পরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পাঠ নিতে গিয়েছিলেন ছাত্র দেবব্রত। তাঁর জন্য নিখরচায় পড়াশোনা, কলকাতায় থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন ত্রিগুণা সেন। কিন্তু সেই দেবব্রতই যখন বাম আন্দোলনের আগুনে ঝাঁপ দিলেন কেরিয়ারের ভাবনা ছেড়ে, সে সময়ে তাঁর ছাত্রকে লেখা ত্রিগুণাবাবুর চিঠি এখনও প্রয়াত নেতার বহরমপুরের বাড়িতে রাখা আছে। সেই প্রসঙ্গই এসেছিল স্মরণসভায়। তার সঙ্গে অবধারিত ভাবেই উঠেছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনকার পরিস্থিতি। তার জের টেনেই বিমানবাবু সাফ বলেন, ‘‘যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে কী ঘটছে, সকলেই দেখছেন। দেবুদা যদি এখন যাদবপুরের ছাত্র হতেন এবং মার্ক্সবাদী ভাবনাচিন্তার ধারক হতেন, তা হলে তিনি হতেন দেশদ্রোহী!’’ মঞ্চে বসে এই কটাক্ষ হজমই করতে হয়েছে বিজেপি নেতাকে!
বিমানবাবু আরও বলেছেন, ‘‘এই অসময়ে আমাদের শপথ নেওয়া উচিত, সাম্যবাদের কথা বললে বা গণ-আন্দোলন সংগঠিত করলে দেশদ্রোহী হয় না!’’ সিপিআই (এম-এল) লিবারেশনের পলিটব্যুরো সদস্য কার্তিক পালও ওই মঞ্চ থেকে বলেছেন, ‘‘সুস্থ থাকলে আক্রান্ত যাদবপুরের হয়ে প্রতিবাদে নিশ্চয়ই দেবুদা থাকতেন। তাঁকে সম্মান জানাতেই ফ্যাসিবাদী ও সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে সকলকে একজোট হয়ে দাঁড়াতে হবে।’’ আর মন্ত্রী হিসাবে রাজভবনে পাশাপাশি ঘরে থাকার স্মৃতি তুলে সূর্যবাবু বলেন দেবব্রতবাবুর আদর্শের লড়াই বিরামহীন ভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা।
সুযোগ পেলেই উদাত্ত কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত ছিল দেবব্রতবাবুর সেরা অবসর যাপন। জীবন-মরণের সীমানা ছাড়ায়ে সংগ্রামে অবিচল এক শিষ্টাচারী রাজনীতিকের এ দিন যখন স্মৃতি তর্পণ করা হচ্ছে রবীন্দ্রসঙ্গীতেই, সব শিবিরের সব প্রতিনিধির একযোগে উপস্থিতি প্রতীকী হয়ে থাকল ভোট-বাজারে!