ভোটের অঙ্কে ভর্তুকির চাল

বেহাল কোষাগারকে আরও চাপ মমতার

নবান্নের খয়রাতি এ বার খাদ্য সুরক্ষাতেও! কয়েক হাজার ক্লাবকে নগদ অনুদান, ইমাম-মোয়াজ্জিনদের ভাতা, সাইকেল বিলির সঙ্গে সঙ্গে মেলা-খেলা-ভূষণ উৎসবে কোটি কোটি টাকা খরচ করে ইতিমধ্যেই আগের সরকারকে তো বটেই, অন্য অনেক রাজ্যকেও পিছনে ফেলে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০১৫ ০৩:৩৯
Share:

নবান্নে সাংবাদিকদের মুখোমুখি মুখ্যমন্ত্রী। শুক্রবার সুদীপ আচার্যের ছবি।

নবান্নের খয়রাতি এ বার খাদ্য সুরক্ষাতেও!

Advertisement

কয়েক হাজার ক্লাবকে নগদ অনুদান, ইমাম-মোয়াজ্জিনদের ভাতা, সাইকেল বিলির সঙ্গে সঙ্গে মেলা-খেলা-ভূষণ উৎসবে কোটি কোটি টাকা খরচ করে ইতিমধ্যেই আগের সরকারকে তো বটেই, অন্য অনেক রাজ্যকেও পিছনে ফেলে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ বার খাদ্য সুরক্ষার নামে দু’টাকা কেজি দরে চাল বিলির ঢালাও ব্যবস্থার কথা ঘোষণা করে বিধানসভা ভোটের আগে আক্ষরিক অর্থেই ‘কল্পতরু’ হয়ে উঠতে চাইলেন মুখ্যমন্ত্রী!

শুক্রবার মুখ্যমন্ত্রীর দেওয়া হিসেব অনুযায়ী, রাজ্যে ভর্তুকির চাল-গম পাবেন ৭ কোটি ৭১ লক্ষ মানুষ। এই সংখ্যাটা এত দিন ছিল ৬ কোটি ১ লক্ষ। শুক্রবার নতুন করে ১ কোটি ৭০ লক্ষ মানুষকে সস্তায় চাল-গম দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ফলে খাদ্যে রাজ্যের ভর্তুকির পরিমাণটাও একলাফে অনেকটাই বেড়ে যাবে। সরকারি হিসেবেই, এই বিপুল পরিমাণ সস্তার চাল খাওয়াতে কোষাগার থেকে বছরে ভর্তুকি দিতে হবে প্রায় ৪২৮২ কোটি টাকা! যা শুনে বিরোধীদের কটাক্ষ, ‘‘নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে, নিত্য-নতুন ডোল বিলিতে মমতা তত মরিয়া হয়ে উঠবেন!’’

Advertisement

মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার ফলে রাজ্যের ঘাড়ে নতুন করে যে আর্থিক বোঝা চাপবে, তার সংস্থান হবে কী ভাবে, তা নিয়ে সংশয়ে নবান্নের কর্তারা। তাঁদের কথায়, ‘‘চলতি আর্থিক বছরের শেষে রাজ্যের ঘাড়ে তিন লক্ষ কোটি টাকা ঋণের দায় চাপতে চলেছে। এই অবস্থায় চালে ভর্তুকির জন্য আরও ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি আর্থিক দায় নেওয়াটা যে যুক্তিসঙ্গত নয়, তা বলাই বাহুল্য।’’ অনেকের প্রশ্ন, যেখানে প্রতি মাসে কর্মীদের বেতন মেটাতে দেড় হাজার কোটি টাকার মতো টাকা বাজার থেকে ধার করতে হয়, সেখানে এত খয়রাতি কেন?

অভিযোগ, সমালোচনা বা যুক্তি যা-ই বলুক, মুখ্যমন্ত্রীর এই ঘোষণায় শাসক দলের অন্দরে রীতিমতো উল্লাস। এ দিন নবান্নে রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে এক মন্ত্রীর সহাস্য মন্তব্য, ‘‘দিদির এক ঘোষণায় রাজ্যের মোট ভোটারের নব্বই শতাংশের ঘরে সস্তার চাল-গম ঢুকে যাবে! আমাদের আর আটকায় কে?’’

অর্থ দফতরের কর্তাদের দাবি, চাল বিলি করে ভোট টানার চেষ্টার জেরে রাজ্যের কোষাগারের অবস্থা আরও বেহাল হয়ে পড়বে। তাঁদের বক্তব্য, একেই কর আদায়ের বৃদ্ধি এ বছর আশানুরূপ নয়। তার উপরে এই বাড়তি বোঝার চাপে রাজ্যের আর্থিক অবস্থা কার্যত কোমায় চলে যাবে!

চাল-গমের ভর্তুকির অঙ্ক যে আসন্ন বিধানসভা ভোটের কথা মাথায় রেখেই কষা হয়েছে, তার ইঙ্গিত মিলেছে মুখ্যমন্ত্রীর কথা থেকেই। মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর তিনি জানান, আগামী বছরের ২৭ জানুয়ারি থেকে এই প্রকল্প শুরু হবে। নবান্নের খবর, বিধানসভা ভোটের ঘোষণা হয়ে যেতে পারে ফেব্রুয়ারি বা মার্চে। যার অর্থ, নবান্নের দাক্ষিণ্যে বিধানসভা ভোটের ঠিক মুখেই রাজ্যের মানুষ সস্তায় চাল-গম পেতে শুরু করবেন।

রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, সস্তায় চাল বিলি করে এর আগে বেশ কিছু রাজ্যের শাসক দল ভোটে বাজিমাত করেছে। চাল বিলির খ্যাতি এমনই ছড়িয়েছে যে ছত্তীসগঢ়ের মুখ্যমন্ত্রী রমন সিংহের নামই হয়ে গিয়েছে ‘চাওল বাবা’। তামিলনাড়ুর জয়ললিতা চাল বিলির প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটে জিতেছেন। একই সুফল পেয়েছে ওড়িশায় নবীন পট্টনায়কও। তাঁদের মতে, সেই পথে হেঁটেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও চাল, সাইকেল-সহ নানাবিধ ডোল বিলিয়ে দ্বিতীয় বারের জন্য ভোট বৈতরণী পার হতে চাইছেন।

কী ভাবে? কেন্দ্রের জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা মিশন প্রকল্প শুরু হওয়ার পর থেকে রেশন ব্যবস্থায় এপিএল, বিপিএল প্রথা উঠে গিয়েছে। প্রকল্প শুরুর আগে ১৩টি বিষয়ের উপরে দেশ জুড়ে একটি আর্থ-সামাজিক জাতিগণনা করেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। তার ভিত্তিতে গরিব এবং অত্যন্ত গরিব এই দুই শ্রেণিতে যাঁদের চিহ্নিত করা হয়েছে— তাঁরাই শুধু খাদ্য সুরক্ষা মিশনের আওতায় আসবেন। এই নিরিখে পশ্চিমবঙ্গের ৬ কোটি ১ লক্ষ মানুষকে মাসে ৩ টাকা কেজি দরে পাঁচ কেজি চাল দেওয়া হবে। এ দিন মুখ্যমন্ত্রী জানান, কেন্দ্র তিন টাকা দরে দিলেও রাজ্য কিন্তু এঁদের দু’টাকা কেজি দরেই চাল দেবে। অর্থাৎ, প্রতি কেজিতে ১ টাকা করে ভর্তুকি দেবে রাজ্য। এ ছাড়াও, খাদ্য সুরক্ষা মিশন শুরু হওয়ার আগে থেকেই আয়লা বিধ্বস্ত এলাকা, সুন্দরবন, জঙ্গলমহল, সিঙ্গুর এবং চা-বাগানের দরিদ্র বাসিন্দাদের দু’টাকা প্রতি কেজি দরে চাল দিত রাজ্য। ওই বাসিন্দারাও এ বার খাদ্য সুরক্ষা মিশনের আওতায় আসছেন। তাঁরা অবশ্য আগের মতোই মাসে ৮ কেজি চাল পাবেন।

কেন্দ্র রাজ্যের যে ৬ কোটি ১ লক্ষ মানুষকে খাদ্য সুরক্ষা মিশনের আওতায় নিয়ে এসেছে, তার বাইরেও বহু বাসিন্দা রয়েছেন, যাঁরা আসলে দরিদ্র বলেই মনে করে রাজ্য। এর মধ্যে এক কোটি লোককে মাথাপিছু মাসে ৫ কেজি করে চাল দেবে রাজ্য। নবান্নের কর্তারা জানান, বহু লোক অভিযোগ করেন, রেশন কার্ড থাকলেও তাঁরা আর্থ-সামাজিক সমীক্ষার আওতায় আসেননি। এই সংখ্যাটা প্রায় ৭০ লক্ষ। এঁদের বঞ্চিত করতে চান না মুখ্যমন্ত্রী। তাই এই অংশকে ‘সাদা ফর্ম’ পূরণ করিয়ে ‘খাদ্য সুরক্ষা মিশন’ প্রকল্পের আওতায় আনা হয়। এঁরা অবশ্য বাজার দরের অর্ধেক দামে রেশন থেকেই মাথাপিছু এক কেজি চাল বা গম প্রতি মাসে নিতে পারবেন। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘আমাদের রাজ্যে ৯ কোটি মানুষ আছেন। রাজ্য সরকার তার ৮০% মানুষকেই খাদ্য সুরক্ষা মিশনের আওতায় নিয়ে আসছে।’’

খাদ্য দফতরের এক কর্তা জানান, রাজ্যে এখন ৯.২৩ কোটি মানুষের রেশন কার্ড আছে। তার মধ্যে ৭ কোটি ৭১ লক্ষ মানুষ কোনও না কোনও ভাবে সস্তার চাল পাবেন। বাদ পড়ছেন ১ কোটি ৫২ লক্ষ মানুষ। প্রশ্ন উঠেছে, এঁদের কী হবে? ওই কর্তার মতে, ‘‘এঁদের প্রত্যেককেই রেশনে চাল-গম নেওয়ার জন্য সাদা ফর্ম পূরণ করতে বলা হয়েছিল। যাঁরা বাদ পড়েছেন, তাঁরা ওই তালিকায় থাকতে চাননি।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement