মিষ্টি হাব অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা শুনে উল্লাস চাষিদের। বৃহস্পতিবার বর্ধমানে। ছবি: উদিত সিংহ।
সিঙ্গুরের বাইরে ছাপ ফেলল সিঙ্গুর মামলার রায়। বৃহস্পতিবার বর্ধমানে চাষিদের বিক্ষোভের জেরে সরকারি ‘মিষ্টি বাংলা হাব’ প্রকল্প অন্যত্র সরানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বলেছেন, ‘‘যেখানে লোকে চাইবে না, কেন হবে (হাব)?’’ ঘটনাচক্রে, বর্ধমান শহরে উল্লাস মোড় লাগোয়া ওই জমিতে এ দিনের বিক্ষোভে উড়েছে শাসক দলের পতাকা। সেই সূত্র ধরে বিরোধীদের বক্তব্য, ‘‘জমি আন্দোলন তৃণমূলকে ক্ষমতায় এনেছে। কিন্তু এখন ওরা শাসক। এ ভাবে আন্দোলন হলে রাজ্যের কোথাও, কিছু করতে পারবে তো সরকার!’’
২০০৫-২০০৭ সালের মধ্যে বাম সরকার আলিশা ও বামচাঁদ মৌজায় ১০.৬৭ একর জমি অধিগ্রহণ করে। ঠিক ছিল, কিছু জমিতে সরকারি বিপণন কেন্দ্র হবে, কিছুটা লাগোয়া সরকারি হাসপাতালকে দেওয়া হবে। জমি ছিল ৮১ জনের। ১৩ জন ক্ষতিপূরণ নেন। দু’জন ক্ষতিপূরণ নিয়েও পরে টাকা ফেরত দেন।
সে জমি পড়ে ছিল। গত মাসে মুখ্যমন্ত্রীবর্ধমানে ফের মিষ্টি হাব তৈরির কথা জানাতে জেলা প্রশাসন সিদ্ধান্ত নেয়, পড়ে থাকা ওই জমিতে ‘মিষ্টি বাংলা হাব’ হবে। সেখানে বর্ধমানের সীতাভোগ, মিহিদানা, ল্যাংচার সঙ্গে রামপুরহাটের রাজভোগ, সিউড়ির মোরব্বা ভিন্-রাজ্যে পাঠানোর পরিকল্পনা ছিল।
গত ২৭ অগস্ট থেকে জরিপ এবং জমিতে বিভিন্ন নির্মাণ সামগ্রী জড়ো করতে শুরু করে প্রশাসন। এ দিন সকালে জমিতে পাঁচিল দেওয়া শুরু হতেই বাধা দেন জনা পঞ্চাশ জমিদাতা। মুখ্যমন্ত্রীর ছবি, তৃণমূলের পতাকা নিয়ে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে থেকে ওই জমিতে যাওয়ার পথে অবস্থান শুরু করেন তাঁরা। খবর পেয়ে সেখানে হাজির হন তৃণমূলের দুই স্থানীয় নেতা নাসিরুল ইসলাম এবং জগন্নাথ মণ্ডল। তাঁরা জমিদাতাদের বলেন, ‘‘আন্দোলন করছেন, করুন। মুখ্যমন্ত্রীর ছবি ও পতাকাগুলো ফেরত দিন।’’ জবাব আসে, ‘‘আমরা সবাই তৃণমূল। দিদি আমাদের নেত্রী।’’ নেতারা ফিরে যান।
বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ মূলত তিনটি। প্রথমত, জমি অধিগ্রহণের বিষয়টি প্রথম সারির সংবাদপত্রে দেওয়া হয়নি। তাই দীর্ঘদিন বিষয়টি জানতেন না চাষিরা। দ্বিতীয়ত, ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত চিঠি সবাইকে দেওয়া হয়নি। তা ছাড়া, ক্ষতিপূরণ হিসেবে ২০০৭ সালে কাঠা প্রতি ৩ থেকে ১৫ হাজার টাকা দর দেওয়া হয়েছে। অথচ, তখন বাজারদর কাঠাপ্রতি ছিল ২-৩ লক্ষ টাকা। এখন তা দাঁড়িয়েছে কাঠা প্রতি কম করে ২০-২৫ লাখ টাকায়। অমিত ঘোষ, সমরেশ ঘোষ, গায়ত্রী ঘোষদের মতো বিক্ষোভকারীদের বক্তব্য, ‘‘সিঙ্গুর মামলার রায়ে উৎসাহী হয়েছি। ওখানে যে-যে কারণে জমি অধিগ্রহণ বেআইনি হয়েছে, এখানেও প্রায় তেমন সব কারণ রয়েছে।’’
বিক্ষোভের খবর পৌঁছয় নবান্ন-এ। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘সমস্যার কথা জেনেছি। বলেছি, ওই জায়গা নেওয়ার দরকার নেই। কারণ, আমরা চাই, সিঙ্গুরের রায়টা সবার ক্ষেত্রেই সমান ভাবে প্রযোজ্য হোক।’’ তিনি জানান, ‘মিষ্টি বাংলা হাব’-এর জন্য অন্যত্র জমি খুঁজতে বলা হয়েছে প্রশাসনকে। প্রশাসন সূত্রের খবর, আজ, শুক্রবার নতুন জমি খোঁজার ব্যাপারে বৈঠক রয়েছে। তবে সিঙ্গুরের মতো এখানেও জমি ফেরত দেওয়া হবে কি না, তা স্পষ্ট করেনি প্রশাসন। জেলাশাসক সৌমিত্র মোহন শুধু বলেন, ‘‘জমির মালিকদের দাবিগুলি আবার খতিয়ে দেখা হবে।’’
মুখ্যমন্ত্রীর বার্তা পৌঁছতেই বিক্ষোভ থামে বর্ধমানে। (ছবি: পৃঃ ৬) আন্দোলনকারীদের উচ্ছ্বাস, ‘‘জানতাম, সিঙ্গুর রায়ের পরে দিদি আমাদের সঙ্গেও থাকবেন।’’ কিছুটা মুষড়ে পড়লেও বর্ধমানের মিষ্টি ব্যবসায়ীদের এক মুখপাত্র বলেছেন, ‘‘কারও চোখের জল পড়বে অথচ আমরা ব্যবসা করব—চাই না।’’
সিঙ্গুর মামলার রায় ও মুখ্যমন্ত্রীর অবস্থানে একই ধরনের ভরসা পাচ্ছেন শিলিগুড়ির কাওয়াখালিতে সরকারি প্রকল্পের অনিচ্ছুক জমিদাতারাও। সেখানে দ্রুত জমি ফেরানোর দাবিতে সরব হয়েছে ‘থিকনিকাটা-কাওয়াখালি ল্যান্ড ওনার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’।
তৃণমূলের তরফে বর্ধমান জেলার ভারপ্রাপ্ত পর্যবেক্ষক তথা মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস জানিয়েছেন, বর্ধমানের এই জমি-সমস্যা নিয়ে দলীয় স্তরে খোঁজ নেবেন। তবে দলের অন্দরের খবর, ঘরোয়া আলোচনায় অনেক শীর্ষ নেতাই মানছেন, সিঙ্গুর-রায়ের প্রভাব ক্রমশ ছড়াচ্ছে।