অযথা দাঁড়াবেন না। উপনির্বাচনে সংঘর্ষ এড়াতে সক্রিয় আধাসেনা। শনিবার বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটে। —নিজস্ব চিত্র
চাপে তা হলে কাজ হল!
খাস কলকাতার চৌরঙ্গি এবং উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাট দক্ষিণ বিধানসভা কেন্দ্রে শনিবার সারা দিন উপনির্বাচনের ছবি দেখে এমনই মনে হচ্ছে অধিকাংশ বিরোধী রাজনৈতিক দল এবং আম জনতারও। গোলমাল বা অশান্তির প্রভূত আশঙ্কা সত্ত্বেও প্রায় নির্বিঘ্নেই উতরে গেল ভোটযজ্ঞ। আর তার জন্য কেন্দ্রীয় আধা-সামরিক বাহিনীর ইতিবাচক ভূমিকাকেই ধন্যবাদ জানাচ্ছেন বিরোধী নেতা-কর্মী এবং ভোটারদের বড় অংশ।
নির্বাচন কমিশন জানাচ্ছে, সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বসিরহাটে ৭৯.৫৯% এবং চৌরঙ্গি কেন্দ্রে ৪৭.১৩% ভোট পড়েছে। গত লোকসভা ভোটে এই হার ছিল যথাক্রমে ৮৫% ও ৫৭%। সাধারণ নির্বাচনের চেয়ে উপনির্বাচনে সচরাচর ভোট পড়ার প্রবণতা কমই থাকে। তাই ভোটদানের শতাংশের চেয়েও ক’মাস আগের লোকসভা ভোটের সঙ্গে এ বারের উপনির্বাচনের তুলনা হচ্ছে নিরাপত্তার নিরিখেই। কেন্দ্রীয় বাহিনীকে নিষ্ক্রিয় রেখে শাসক দল অবাধে ‘ভোট লুঠ’ করেছে, লোকসভা নির্বাচনে এমন ভূরি ভূরি অভিযোগ ছিল বিরোধীদের। যে জন্য এ বার গোড়া থেকে নির্বাচন কমিশনের উপরে চাপ রেখেছিল তারা। দিনের শেষে কমিশনের ভূমিকায় বিরোধীরা মোটের উপর খুশিই। ক্ষেত্রবিশেষে অসন্তুষ্ট শাসক দল।
এবং এখানেই শুরু হচ্ছে পরবর্তী কাউন্ট ডাউন! উপনির্বাচন যাতে নির্বিঘ্নে হয়, সে জন্য বেশি সক্রিয় হয়েছিল বিজেপি-ই। মুখতার আব্বাস নকভি, সিদ্ধার্থনাথ সিংহের মতো কেন্দ্রের শাসক দলের সর্বভারতীয় নেতারাও রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক (সিইও) সুনীল গুপ্তের দফতরে এসে নিরপেক্ষ ভোট ও যথাযথ কেন্দ্রীয় বাহিনীর দাবি জানিয়ে গিয়েছিলেন। এখন প্রশ্ন হল, সারদা-কাণ্ডে কোণঠাসা এবং লোকসভা ভোটের নিরিখে দু’টি বিধানসভা কেন্দ্রেই পিছিয়ে থাকা তৃণমূলকে ধাক্কা দিয়ে রাজ্য বিধানসভায় বহু দিন বাদে কি ফের প্রতিনিধি পাঠাতে পারবে বিজেপি। কেন্দ্রের শাসক দল রাজ্যে তাদের সাম্প্রতিক উত্থানের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারবে কি না, জানা যাবে মঙ্গলবার।
পক্ষান্তরে তৃণমূলের সামনে চ্যালেঞ্জও কিছু কম নয়। সারদার ছায়ায় এই উপনির্বাচনে হারলে আরও মার খাবে দলের মনোবল। ঘাড়ের উপরে উঠে আসবে বিজেপি। ২০১১-র বিধানসভা ভোটে সিপিএম বসিরহাট দক্ষিণ আসনে জিতলেও রাজ্য জুড়েই অবক্ষয়ের আবহে তারা লড়াইয়ে বলতে গেলে প্রায় নেইই। একই দশা কংগ্রেসের।
এই সামগ্রিক সমীকরণ থেকেই এ দিন দুই কেন্দ্রেই ময়দানে টক্কর হয়েছে তৃণমূল ও বিজেপি-র। চৌরঙ্গিতে রীতেশ তিওয়ারি এবং বসিরহাটে শমীক ভট্টাচার্য, গেরুয়া শিবিরের দুই প্রার্থীই তৃণমূলের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে লড়ে গিয়েছেন। কোথাও দলীয় কর্মী-সমর্থকেরা আক্রান্ত হওয়ার পরিস্থিতি হলেই সাধ্যমতো পাশে দাঁড়িয়েছেন। তবু এই আবহেও বড়সড় সংঘর্ষ, রক্তপাত যে ঘটেনি, তার কৃতিত্ব কেন্দ্রীয় বাহিনীকেই দিতে হবে। কলকাতাতেই সুরেন্দ্রনাথ কলেজে সিপিএমের কা্যাম্প অফিসে তৃণমূলের হামলার অভিযোগ উঠেছে, আহত হয়েছেন মহিলারা। কিন্তু সার্বিক বিচারে এই ধরনের ঘটনা বিক্ষিপ্তই।
কেমন কাজ করেছে কেন্দ্রীয় বাহিনী? দুই কেন্দ্রের দুই তৃণমূল প্রার্থীকে নিয়ে দু’টুকরো ছবিই উত্তর দিতে পারে:
আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের কাছে হাজি মহম্মদ মহসিন স্কোয়ারে তামিল চার্চ স্কুলের বুথে দু’-তিন জন সঙ্গীকে নিয়ে গটগটিয়ে ঢুকতে গিয়ে আটকে গেলেন গোলাপি-সাদা কোরা শাড়ির মহিলা। স্বর সপ্তমে চড়িয়ে তৃণমূল প্রার্থী নয়না বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রায় আর্তনাদ শোনা গেল, “হচ্ছেটা কী! আমরা তো খাবার নিয়ে ঢুকছি। আমাদের ছেলেগুলোকে নাস্তা পর্যন্ত করতে দেবে না!” বিএসএফের দীর্ঘদেহী উর্দিধারীর নিরুত্তাপ জবাব: ‘‘নেহি ম্যাডাম, আদেশ নেহি হ্যায়!” অনেক অনুনয়ে শেষমেশ এক জন দলীয় কর্মীর ঢোকার অনুমতি মিলতে কোনও ক্রমে খাবারের প্যাকেট পৌঁছে দিয়ে এসেছেন তিনি। রকমসকম দেখে পরে এক বার নয়নাকে বলতে শোনা গিয়েছে, “কী শুরু করেছে সিআরপি!”
উত্তর ২৪ পরগনার সীমান্ত-ঘেঁষা এলাকা বসিরহাটের ছবিও খাস কলকাতার থেকে বিরাট আলাদা নয়। সেখানেও ইটিন্ডার কলাপোতা গ্রামের বেনেবউ প্রাথমিক স্কুলের বুথে ঢুকতে গিয়েছিলেন তৃণমূল প্রার্থী দীপেন্দু বিশ্বাস। তাঁকেও আটকেছে বিএসএফ। তিনি প্রার্থী জানানোর পরেও আধা-সামরিক জওয়ানেরা ছাড়েননি বলে দীপেন্দুর দাবি। শেষমেশ পরিচয়পত্র দেখানোর পরেই তাঁকে যেতে দেওয়া হয় বুথের ভিতরে।
উপনির্বাচনের দিনের এমন ছবি দেখেই ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে কারও কারও। চৌরঙ্গির বিজেপি প্রার্থী রীতেশ যেমন বলেছেন, “২০১১-র পরে রাজ্য এমন অবাধ ভোট দেখেনি।” বসিরহাটের বিজেপি প্রার্থী শমীক বলেছেন, “তৃণমূল ছাপ্পা মারতে পারেনি। ওরা ভোট লুঠ করার চেষ্টা করলে কেন্দ্রীয় বাহিনী বাধা দিয়েছে। আমরাও তৎপর ছিলাম।” আগামী ২০১৬-র বিধানসভা ভোটে সামান্য পরিবর্তন করে উপনির্বাচনের এই মডেলকেই তুলে ধরার পক্ষে সওয়াল করেছেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ। আর দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের তরফে এ রাজ্যের পর্যবেক্ষক সিদ্ধার্থনাথ সিংহের কথায়, “লোকসভার তুলনায় ভোট শান্তিতে হয়েছে। এই উপনির্বাচনের ফল হয়তো পশ্চিমবঙ্গে প্রকৃত বিকল্পের সন্ধান দেবে।” দিল্লি ফিরে দলের সভাপতি অমিত শাহকে রিপোর্ট দিচ্ছেন তিনি।
অশান্তির উপদান বা নাগরিকদের ভয় দেখিয়ে বুথ থেকে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টায় অবশ্য খামতি ছিল না! যেমন গত ক’দিন ধরেই বসিরহাট-হাসনাবাদ-টাকির সব হোটেল, গেস্ট হাউসে ভিড় অপরিচিত হাতকাটা, গালকাটা চেহারার কিছু লোকজনের! শিয়ালদহ, বৌবাজারের কিছু হোটেল-লজেও শাসক দলের ঘনিষ্ঠ কিছু বিতর্কিত চরিত্র জড়ো হন বলে চৌরঙ্গির সিপিএম প্রার্থী ফৈয়াজ আহমেদ খানের অভিযোগ। ভোট চলাকালীন শাসক দলের কোনও বহিরাগত নেতা বা পুলিশের খাতায় দাগি কাউকে কাউকে দেখাও গিয়েছে। কিন্তু নাগরিকদের চলাফেরা বা ভোটদানে তার বিশেষ প্রভাব চোখে পড়েনি। কেন্দ্রীয় বাহিনীর ভূমিকাকেই এখানে নম্বর দিচ্ছে আমজনতা।
কী বলছে কমিশন? সিইও সুনীলবাবুর দাবি, শান্তিপূর্ণ ও অবাধ ভোটে দু’-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে। তিনি বলেন, “অভিযোগ আসার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।” এক কর্তার মন্তব্য, “পেনাল্টি বক্সে ঢোকা দূরে থাক, যাবতীয় অশান্তির উপাদান মাঝমাঠেই ঠেকানো ছিল আমাদের স্ট্র্যাটেজি!” ভোটের ঠিক আগে বৃহস্পতি-শুক্রবার কমিশনের তরফে কলকাতায় অভিযান চালিয়ে হোটেল-লজ-অনুষ্ঠান বাড়ি ফাঁকা করা হয়। কড়া নজরদারি ছিল বসিরহাটেও। শুক্রবার রাতে নির্বাচনী পর্যবেক্ষক ভুবনেশ যাদব কেন্দ্রীয় বাহিনী ও উত্তর ২৪ পরগনার অতিরিক্ত এসপি ভাস্কর মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে অভিযানে বেরোন। ভোটের দিনও আধা-সামরিক বাহিনীর দৃঢ়তায় গোলমেলে লোকজন ট্যাঁ-ফোঁ করতে পারেনি!
এই ছবিই আশ্বস্ত করেছে বিরোধী শিবিরকে। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী যেমন ভোটের হার কম পড়ায় উদ্বিগ্ন হলেও কেন্দ্রীয় বাহিনীর ভূমিকায় খুশি। কংগ্রেস প্রার্থী বসিরহাটের অসিত মজুমদার বা চৌরঙ্গির সন্তোষ পাঠকও জওয়ানদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। উত্তর ২৪ পরগনার সিপিএম জেলা সম্পাদক গৌতম দেব মন্তব্য করেছেন, কেন্দ্রীয় বাহিনীর কড়া নজরদারিতে শাসক দল গোলমাল পাকাতে পারেনি। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য রবীন দেবের অভিযোগ, কয়েকটি জায়গায় কেন্দ্রীয় বাহিনীকে পুলিশ বিভ্রান্ত করেছে।
লক্ষ্যণীয় ভাবে, শাসক দলের কিছু দাপুটে নেতার কাছে কিন্তু কেন্দ্রীয় বাহিনীর এই তৎপরতাই ‘বাড়াবাড়ি’ ঠেকেছে। চৌরঙ্গির তৃণমূল প্রার্থী নয়নার অন্যতম ‘বল-ভরসা’, ৬২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ইকবাল আহমেদ যেমন বলে ফেলেন, “যেন কাশ্মীরের ভোট দেখছি!” লোকসভার মতো রাজ্য বা কলকাতা পুলিশকে দিয়ে যে এখানে বিশেষ কিছু করা যায়নি, তা-ও ধরা পড়েছে তৃণমূল নেতাদের কথায়। ইকবালই যেমন এক বার ক্রুদ্ধ স্বরে বলে ফেলেছেন, “কলকাতা পুলিশকে দেখ, যেন বুথের বাইরে দারোয়ানি করতে এসেছে!”
তৃণমূলের তরফে সামগ্রিক ভাবে দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য ভোট নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেননি। বরং, শাসক দলের বিরুদ্ধে কংগ্রেস, বিজেপি, সিপিএমের নানা অভিযোগকে এক হাত নিয়ে তাঁর কটাক্ষ, “এটা পরিষ্কার, ভোটারদের উপরে ওদের কোনও আস্থা নেই! তাই যত কাল্পনিক গল্প ফাঁদছে। হারের আগেই ওরা হেরে বসে আছে!”