—নিজস্ব চিত্র
সোদপুরে ঐতিহ্যবাহী গাঁধী আশ্রম বাঁচাতে উদ্যোগী হল কেন্দ্রীয় সরকার। বেশ কিছু কাল প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে ৮৯ বছরের ওই ‘খাদি প্রতিষ্ঠান’। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে নানা নথি, ছবি। মূলত পরিকল্পনার অভাবে বহু খরচে তৈরি অতিথিশালা গোড়া থেকেই অব্যবহৃত পড়ে। কী ভাবে সেটির ভোলবদল ঘটানো সম্ভব, তা খতিয়ে দেখতে ক’দিন আগে এক অভিজ্ঞ স্থপতি-সংস্থাকে কেন্দ্রের পক্ষ থেেক দায়িত্ব দিয়েছে আমদাবাদের সবরমতী গাঁধী আশ্রম-কর্তৃপক্ষ।
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সহযোগী, মহাত্মা গাঁধীর এক স্নেহভাজন সতীশচন্দ্র দাশগুপ্ত বেঙ্গল কেমিক্যালসের চাকরি ছেড়ে ১৯২১ সালে তৈরি করেন এই আশ্রম। লক্ষ্য ছিল, গাঁধীজির ভাবাদর্শ অনুযায়ী হাতে কাটা চরকায় সুতো, খাদি বস্ত্র, মধু, ধুপকাঠি প্রভৃতি তৈরি। উদ্বোধনে গাঁধীজি ও মতিলাল নেহরু ছাড়া সে কালের জাতীয় স্তরের বিখ্যাত কিছু ব্যক্তি হাজির ছিলেন। পরে বারবার এখানে এসেছেন গাঁধীজি। বলেছেন, এটি তাঁর ‘দ্বিতীয় গৃহ’। সম্প্রতি সোদপুরে গিয়ে দেখা গেল, পৌনে তিন বিঘা জমির উপরে তৈরি আশ্রমে শ্মশানের নৈঃশব্দ। এককালের সাজানো বাগান এখন ঝোপঝাড়ে ভরা। নালা, ছাদের টালি বিভিন্ন জায়গায় ভেঙে গিয়েছে। আশ্রমের ন’টি বড় ঘর প্রতিটিই তালাবন্ধ। বছর নয়েক আগে আশ্রম-চত্বরের পিছন দিকে অতিথি-নিবাস হিসাবে তৈরি হয়েছিল তিনটি ডর্মিটরি ও ১২টি বাথরুম। ব্যবহার না হওয়ায় আগাছা জড়িয়ে ধরছে সেগুলিকে।
দেড় দশক ধরে অবৈতনিক ভাবে আশ্রমের তত্ত্বাবধানের কাজ করছেন বেসরকারি সংস্থার কর্মী শঙ্কর চক্রবর্তী। তিনি ঘর খুলে দেন। দেওয়াল বেয়ে উঠছে উইয়ের সারি। তার মধ্যে মেঝেতে বাঁশের ফ্রেমে অবিন্যস্ত ভাবে পড়ে গাঁধীজির প্রচুর ছবি। এক সময়ে যে ঘরে মহিলারা তাঁত চালাতেন, তা ঝুলে ভরা, ভাঙা তাঁত ও যন্ত্রের কাঠামোগুলো পড়ে। আশ্রমে তাঁত বোনা শেষ হয়ে যায় ২০০০ সালে। একটি ঘরে গাঁধীজির বিছানা পড়ে আছে অযত্নে। তাঁর নানা সংগৃহীত ছবি প্রদর্শনের জন্য বরাত দিয়ে বানানো হয়েছিল ৬ ফুট উঁচু, ৬ ফুট দীর্ঘ কাঠের ফ্রেমে কাচ ঘেরা দেওয়া ১৮টি সুদৃশ্য শো-কেস। দু’টি ঘরে সেগুলো পড়ে। ধুলোর চাদরে ঢাকা পুরো কাচের তৈরি আরও দু’টি বড় শো-কেস ছিল। একটি ভেঙে গিয়েছে। ধুলোয় ভরা ৮টি চেয়ার দেখিয়ে স্থানীয় প্রবীণ আশুতোষ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “জানেন, ওই এক একটা চেয়ার কেনার বিল হয়েছিল ১২ হাজার টাকা করে। অব্যবহৃত, পরিত্যক্ত আসবাবগুলোর জন্য সরকারি তহবিল থেকে খরচ হয়েছিল ১২ লক্ষ টাকা।”
কেন এই হাল? ১৯৭৪ থেকে এই আশ্রমের সচিবের দায়িত্বে প্রবীণ গাঁধীবাদী অসিতরঞ্জন দাস। তাঁর বক্তব্য, “অনেক আগেই এটা নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। বহু কষ্টে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেছি। দিল্লি থেকে বরাদ্দ আনিয়ে মানোন্নয়নের চেষ্টা করেছি। পারিনি রাজ্য সরকারের উদাসীনতায়।” কেন্দ্র থেকে অর্থ বরাদ্দ হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “সে টাকায় আশ্রম সাজানোর দায়িত্ব ছিল পর্যটন দফতরের। অনেক কাজই হয়নি।” বাম আমলে কিছু আমলার লুটেপুটে খাওয়ার অভিযোগও তোলেন তিনি।
অর্থ বরাদ্দ করা সত্ত্বেও আশ্রমে কী কী হয়নি? অসিতবাবু ও শঙ্করবাবু জানান, আলো ও ধ্বনি প্রকল্প, সামনের রাস্তার সংযোগকারী মূল প্রবেশপথ ও ভিতরের রাস্তা তৈরি, পড়ে থাকা ছবি ফ্রেমে পরিকল্পনা মাফিক লাগানো, দেওয়ালের নোনা আটকাতে ব্যবস্থা —প্রভৃতি কাজ বাকি পড়ে। রক্ষী না থাকায় সীমানা প্রাচীরে সরকারি অর্থে লাগানো ক’টি বাতিস্তম্ভ চুরি হয়ে গিয়েছে। সন্ধ্যার পরে অন্ধকারে ঢেকে যায় সব।
উত্তর ২৪ পরগনা জেলা প্রশাসনে এক আধিকারিকের বক্তব্য, “আমাদের পক্ষে যতটা করা সম্ভব, ওঁদের সঙ্গে সহযোগিতা করি। স্থানীয় পুরসভাকে বলে এক বার ২৪ ঘণ্টা রক্ষী নিয়োগের ব্যবস্থা করেছিলাম। বছর দুই বাদে পুরসভা রক্ষী কম থাকার যুক্তি দেখিয়ে তা তুলে নেয়। আশ্রমের বিদ্যুৎ মাসুলও আমরা মেটাই।” ওই অফিসার জানান, ২০০৪-০৫ সালে পূর্ত দফতর এবং ২০০৭-০৮ সালে পর্যটন দফতর আশ্রমের কিছু কাজ করেছিল। কিন্তু সে সব তদারকির ও পরে রক্ষণাবেক্ষণের কোনও ব্যবস্থা হয়নি। অতিথিশালা করার আগে খতিয়ে দেখা হয়নি, কে বা কারা দেখভাল করবেন, কী শর্তে, কোন ধরনের আবাসিক সেখানে থাকবেন। পর্যটন দফতরের এক অফিসার বলেন, “ইট-গ্রিল দিয়ে আশ্রমের সীমানা, নিকাশি ও আলোর ব্যবস্থা হয়েছিল।”
আশ্রমের হাল ফেরানোর কাজ দেখভাল করছে আমদাবাদের ‘সবরমতী আশ্রম প্রিজার্ভেশন অ্যান্ড মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’। পরিকল্পনাটা কী রকম? এক পদস্থ অফিসার বলেন, “গোটা দেশে গাঁধীজির সঙ্গে গভীর ভাবে সম্পৃক্ত কিছু কেন্দ্র নির্বাচন করা হয়েছে। ওই সব কেন্দ্রের ঠিক কোন অংশে গাঁধীজি কী করতেন, সেখানকার বর্তমান হাল কেমন, আগের পরিমণ্ডল তৈরির কতটা অবকাশ রয়েছে, পুরনো আবহ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের মতের মতো নির্দিষ্ট কিছু জিনিস জানা দরকার। স্থপতি নিয়োগ করা হয়েছে। গাঁধী আশ্রমটি তালিকায় আছে।” স্থপতি-সংস্থার রিপোর্ট পেলে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা হবে বলে তিনি জানান।
আশ্রম তহবিল শূন্য হয়ে যাওয়ায় বেতনভুক কোনও কর্মীও নেই। পালিত হয় না গাঁধীজির জন্মদিন। গুটিকয় স্থানীয় মানুষ ৩০ জানুয়ারি নিজেদের টাকায় ফুল-মালা, মিষ্টি-ধুপকাঠি কিনে পালন করেন ‘শহিদ দিবস’। বৃষ্টির জল না শুকোনো পর্যন্ত আশ্রমে জমে থাকে। পানীয় জলের পাম্প খারাপ। গাঁধীজির ছবি আর বোর্ড থাকলেও বোর্ডে সে সব লাগানোর লোক নেই। প্রায় জন্মলগ্ন থেকে এক কোণে এক হরিজন পরিবার আছে আশ্রিত হিসাবে। অন্ধকার ছাড়াও তাদের নিত্য আশঙ্কা আশ্রমের ঝোপে ক্রমবর্ধমান সাপ নিয়ে।
গাঁধী আশ্রমে নানা সময়ে এসেছেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় থেকে ইন্দিরা গাঁধী, আন্তর্জাতিক বেশ কিছু শীর্ষ রাষ্ট্র প্রতিনিধি। ১৯৩৯-এর মার্চে ত্রিপুরী কংগ্রেসের পরে গাঁধীজির সঙ্গে এই আশ্রমেই এক বৈঠকে বসেন সুভাষচন্দ্র বসু, জওহরলাল নেহরুরা। এর পরেই কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন সুভাষ। ১৯৪৬-এর অক্টোবরে গাঁধী-জিন্নার ব্যর্থ বৈঠক, জিন্নার ‘রাজাজি সূত্র’ প্রত্যাখ্যান প্রভৃতির পরে পৃথক পাকিস্তানের দাবি জোরালো হয়ে ওঠে। সোদপুরের গাঁধী আশ্রম তখন দেশের রাজনীতিকদের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। সে বছর ১০ অক্টোবর লক্ষ্মীপুজোর দিন নোয়াখালিতে দাঙ্গা শুরু হয়। বাংলায় মুসলিম লিগের মুখ্যমন্ত্রী এইচ এস সুরাহবর্দি, গভর্নর ফ্রেডেরিক বারোজ প্রমুখের সঙ্গে কথা বলে গাঁধীজি ক্রমাগত চেষ্টা করছিলেন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের। কাজ না হওয়ায় নিজেই সোদপুর থেকে রওনা দেন নোয়াখালি। তাঁর সহকারী নির্মল বসু জানিয়েছেন সে সব কথা।
ইতিহাসের এই ভূকেন্দ্রটি আপাতত নিশ্চল। এখন এই আশ্রমটিকে বাঁচাতে সবরমতীর কর্তারা কতটা সফল হবেন, তাঁদের চেষ্টা কতটা সুদুরপ্রসারী হবে— প্রশ্ন আশ্রম কর্তাদেরই।