বিপর্যয় মোকাবিলা কেন্দ্রই বিপর্যস্ত

শিলিগুড়ি থেকে বিহার মোড় হয়ে নকশালবাড়ি যাওয়ার ৩১-সি জাতীয় সড়কের ধারে হাতিঘিষায় নীল-সাদা রঙের বড় মাপের ভবন। পাশ দিয়ে বইয়ে চলেছে মাঞ্ঝা নদী। ভবনের সামনের বিরাট চওড়া রাস্তা জাতীয় সড়কে এসে মিশেছে। এলাকায় বড় বড় হোর্ডিং। তাতে লেখা রাজ্য সরকারের বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের উত্তরবঙ্গের ডিসাস্টার ম্যানেজমেন্ট দফতরের ‘মাল্টি ডিসিপ্লিনারি সেন্টার’।

Advertisement

কৌশিক চৌধুরী

হাতিঘিষা (নকশালবাড়ি) শেষ আপডেট: ০৩ জুলাই ২০১৫ ০২:৫৮
Share:

মিরিকের টিংলিংয়ে উদ্ধারকাজ

শিলিগুড়ি থেকে বিহার মোড় হয়ে নকশালবাড়ি যাওয়ার ৩১-সি জাতীয় সড়কের ধারে হাতিঘিষায় নীল-সাদা রঙের বড় মাপের ভবন। পাশ দিয়ে বইয়ে চলেছে মাঞ্ঝা নদী। ভবনের সামনের বিরাট চওড়া রাস্তা জাতীয় সড়কে এসে মিশেছে। এলাকায় বড় বড় হোর্ডিং। তাতে লেখা রাজ্য সরকারের বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের উত্তরবঙ্গের ডিসাস্টার ম্যানেজমেন্ট দফতরের ‘মাল্টি ডিসিপ্লিনারি সেন্টার’। এক বছর আগে সেন্টারটি তৈরি হলেও তা ছাত্রছাত্রী বা স্বেচ্ছাসেবকদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসাবেই চলছে বলে অভিযোগ। বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য কিছু সিভিল ডিফেন্সের কর্মী, হাতে গোনা যন্ত্রপাতি, গাড়ি ছাড়া সেন্টারটিতে তেমন কোনও পরিকাঠামো নেই বলেও অভিযোগ উঠেছে।
উত্তরবঙ্গে দার্জিলিঙের ধস, রাস্তা বন্ধ ছাড়াও জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার জেলার বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হওয়া নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি বেশ কয়েক বার ভূমিকম্পও হয়েছে। তারপরেও সেন্টারটি তৈরির পর এখনও কেন সেখানে বিশেষ ‘স্পেশালাইজড ইউনিট’ রেখে আধুনিক পরিকাঠামো গড়ে তোলা হল না, সেই প্রশ্নই বিভিন্ন মহলে ওঠা শুরু করেছে। বিশেষ করে গত দুই দিনের পাহাড়ের পরিস্থিতির পরে এই প্রশ্ন আরও জোরালো হয়েছে। তা‌ই দার্জিলিঙের ধস বা জলপাইগুড়ির বন্যা পরিস্থিতিতে প্রথমেই ডাকতে হয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীনে থাকা ন্যাশনাল ডিসাস্টার রেসপন্স ফোর্স (এনডিআরএফ), সশস্ত্র সীমা বল (এসএসবি) বা খোদ সেনাবাহিনীকে।

Advertisement

সরকারি সূত্রের খবর, কোনও এলাকায় বিপর্যয় হলে সেনা বা আধা সেনা ডাকা হয় ঠিকই। কিন্তু বিপর্যয় হলে কোথাও এই ধরনের সেন্টার থাকলে সেখানকার আধুনিক সরঞ্জাম-সহ প্রশিক্ষিত কর্মীদের দিয়েই কাজ শুরু করা হয়। এ বার সিভিল ডিফেন্সের কর্মীরা কাজে নামলেও উত্তরবঙ্গের বিপর্যয় মোকাবিলার দফতরের প্রধান কেন্দ্রটির এখনও কোনও ভূমিকাই নেই। সেন্টারটির ‘বেহাল’ পরিস্থিতির কথা শুনেছেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেবও।

তিনি বলেন, ‘‘গোটা উত্তরবঙ্গের জন্য সেন্টারটি তৈরি করা হয়েছিল। সব ধরনের বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য প্রশিক্ষিত কর্মী, আধুনিক যন্ত্রপাতি সেখানে থাকার কথা ছিল। অনেক কিছুই হয়নি বলে শুনছি। আমি বিস্তারিত ভাবে মুখ্যমন্ত্রীকে বিষয়টি জানাচ্ছি। দ্রুত এই অবস্থার পরিবর্তন করা জরুরি।’’

Advertisement

নতুন রাজ্য সরকার ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পরেই উত্তরবঙ্গের জন্য এই সেন্টারটি আলাদা করে তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। ওই সময়ই (২০১০-২০১১) পাহাড়ে বিধ্বংসী ধস, ভূমিকম্প হয়। যার জেরে আজও ৫৫ নম্বর জাতীয় সড়কটি বন্ধ। ২০১২ সালে বিভাগীয় মন্ত্রী জাভেদ খান প্রকল্পের শিলান্যাসও করেন। উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দফতর প্রায় ৫ কোটি টাকা দিয়ে ভবনটি তৈরি করে। কাজও বছর খানেকের মধ্যে শেষ হয়। কিন্তু তার পরে ভবনটিতে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালানো ছাড়া আর তেমন কোনও উন্নতি করা হয়নি বলে অভি‌যোগ। তবে কেন্দ্রটি সচল রয়েছে বলে দাবি করেছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক তথা শিলিগুড়ির মহকুমা শাসক দীপাপ প্রিয়া।

প্রশাসনিক সূত্রের খবর, বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের কিছু কর্মী সেখানে যাতায়াত করলেও অফিসার, কর্মী দিয়ে অফিস পুরোপুরি চালু হয়নি। প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরের শিলিগুড়ি মহকুমা শাসকের দফতর থেকে তার দেখভাল হয়।

পরিস্থিতি এমন যে, গত মাসেই নকশালবাড়ি পানিঘাটা মোড়ে পড়ে যাওয়া একটি গাছ পুরোপুরি যন্ত্রপাতি, মেশিনের অভাবে সরাতে পারেননি কেন্দ্রের কয়েকজন কর্মী। শেষে পূর্ত বিভাগ থেকে ক্রেন এনে তা সরিয়ে বন্ধ হওয়া দুটি রাস্তা খুলতে হয়। স্থানীয় মাটিগাড়া-নকশালবাড়ি বিধানসভা কেন্দ্রের কংগ্রেসের বিধায়ক শঙ্কর মালাকার বলেন, ‘‘হাততালি কুড়োতে কোটি কোটি টাকা খরচ করে এই প্রকল্প করা হয়েছে। আর এখন সেন্টারটিরই বিপর্যয় দশা। আধুনিকতা তো দূরের কথা, উত্তরবঙ্গ বিপর্যয় মোকাবিলার মূল কেন্দ্রে লোকবল, অফিস, কন্ট্রোল রুম, যন্ত্রপাতি প্রায় কিছুই নেই। গত মাসের ভূমিকম্পে নানা জায়গায় চিড় ধরেছি শুনেছি।’’

সমতলের মতো সেন্টারটিকে নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে পাহাড়েও। পাহাড়ের কালিম্পং মহকুমা বরাবরই ধস প্রবণ। তা ছাড়া কালিম্পংবাসীকেই প্রতি বছর ১০ নম্বর জাতীয় সড়কের ঝক্কি সামলাতে হয়। গত বুধবারও কালিম্পং-সহ লাভা, গরুবাথান, আলগাড়ায় ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। উদ্ধার কাজে নেমেছে কেন্দ্রের প্রশিক্ষিত বাহিনীই। টানা নয় বছর কালিম্পং পুরসভায় চেয়ারম্যান ছিলেন চন্দ্রকুমার কুমাই। তিনি বলেন, ‘‘পার্বত্য পরিষদ থেকে জিটিএ আমল, পাহাড়ে এমন সেন্টার হলই না। আবার সমতলে অবস্থানগত কারণে যেটা হল, তা তো অচল শুনছি। আমাদের সেই তিমিরেই থাকতে হচ্ছে।’’

আবার গোর্খা লিগের সাধারণ সম্পাদক প্রতাপ খাতি বলেছেন, ‘‘সেন্টারটিকে ঠিকঠাক ভাবে না তৈরি করে, সব সময় সেনা বা আধা সেনার উপর ভরসা করতে হচ্ছে। সরকারের বিষয়টি ভাবা দরকার।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement