রাজ্য কোষাগারের নাকি ‘ভাঁড়ে মা ভবানী’ দশা! তবু মা-মাটি-মানুষের সরকারের উৎসব পালনে খামতি নেই।
পুরভোটের পাট চুকতেই ফের উত্সবে মাততে চলেছে বাংলা! তৃণমূল সরকারের চতুর্থ বর্ষপূর্তি এ বার। আর তা উদ্যাপনের জন্যই নবান্ন থেকে জেলায় জেলায় পৌঁছে গিয়েছে নির্দেশিকা। জানানো হয়েছে, কোন এলাকায় কী কী অনুষ্ঠান করতে হবে।
আগামী ২০ মে তৃণমূল সরকারের চতুর্থ বর্ষপূর্তি। নবান্নের নির্দেশ, ওই দিন বিকেল চারটেয় প্রতি ব্লকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতে হবে। অন্তত ৩০ জন লোকশিল্পীকে এই অনুষ্ঠানে যুক্ত করতে হবে। অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কন্যাশ্রী, যুবশ্রী, শিক্ষাশ্রী, লোকপ্রসার প্রভৃতি প্রকল্পের সাফল্যের দিকগুলো তুলে ধরতে হবে। অনুষ্ঠানে গান হবে— ‘নির্মল বাংলা অভিযান/ সবে মিলে রাখব নারী জাতির সম্মান’ অথবা ‘ও খোকার বাপ খোকার জন্য শৌচাগার বানাও না/ভবিষ্যতে ভাবনা রবে না/ রোগ জীবাণুর ভাবনা রবে না’ কিংবা ‘আজ কন্যাশ্রী প্রকল্পে বাজিছে বাজনা/ আজ ঝুমুর পানা তা না নানা না’। অনুষ্ঠানের জন্য ব্লকপিছু ১০ হাজার টাকা করে বরাদ্দ রাখা হয়েছে। আর মহকুমা স্তরে দেওয়া হবে ৭০ হাজার টাকা। শিল্পীদের পারিশ্রমিক অবশ্য তথ্য-সংস্কৃতি দফতর দেবে। অনুষ্ঠান মঞ্চের পিছনের ব্যানারের নকশা নবান্ন থেকে যথা সময়ে পাঠিয়ে দেওয়া হবে বলেও জানানো হয়েছে নির্দেশিকায়।
প্রতি মহকুমায় দু’টি করে ট্যাবলো বেরোবে। ২০ থেকে ২৪ মে— পাঁচ দিন ধরে ট্যাবলোগুলি গ্রামে গ্রামে ঘুরবে। অন্তত ৫ জন করে লোকশিল্পী থাকবেন এখানে। ট্যাবলো থেকেও সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের সাফল্য তুলে ধরতে হবে। এ জন্য গাড়িপিছু ৭ হাজার টাকা বরাদ্দ হয়েছে। এ ক্ষেত্রেও শিল্পীদের পারিশ্রমিক দেবে তথ্য সংস্কৃতি দফতর। প্রত্যেক লোকশিল্পীর দিনে পারিশ্রমিক হিসেবে এক হাজার টাকা পাওয়ার কথা। পশ্চিম মেদিনীপুরে মোট ২৯টি ব্লক। ফলে এই জেলায় অন্তত ৮৭০ জন লোকশিল্পী এই অনুষ্ঠানে যুক্ত হবেন। প্রত্যেক শিল্পীকে দিনে ১ হাজার টাকা করে সাম্মানিক দেওয়া হবে। ৪টি মহকুমা রয়েছে। এক-একটি ট্যাবলোয় ৫ জন করে থাকলে মহকুমাস্তরে অন্তত ৪০ জন লোকশিল্পী এই অনুষ্ঠানে যুক্ত হবেন। জেলা প্রশাসনের এক আধিকারিক বলছিলেন, “শিল্পীদের পারিশ্রমিক বাবদই প্রায় ৯ লক্ষ টাকা খরচ হবে।’’ এতে অবশ্য শিল্পীরা খুশি। বিখ্যাত ঝুমুর শিল্পী পানমনি বেসরার কথায়, “বেসরকারি অনুষ্ঠানেও এত টাকা পাওয়া যাচ্ছে না। ভাল লাগছে।’’
তবে এত অর্থ ব্যয় করে সরকারের বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা নিয়ে তৃণমূলকে বিঁধতে ছাড়ছে না বিরোধীরা। তাদের বক্তব্য, মুখ্যমন্ত্রী মাঝেমধ্যেই দাবি করেন, রাজ্য কোষাগারের হাল খারাপ। কেন্দ্রকে ঋণ শোধ দিতে বহু টাকা চলে যাচ্ছে। তাই তিনি চেয়েও পর্যাপ্ত উন্নয়ন করতে পারছেন না। তা-ও কেন লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে মা-মাটি- মানুষের সরকারের বর্ষপূর্তি পালন করা হচ্ছে, সেই প্রশ্নই তুলছে বিরোধীরা। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য দীপক সরকার বলেন, “ফসলের দাম না পেয়ে চাষি আত্মহত্যা করছেন। একশো দিনের কাজের মজুরি বাকি। এ সব দিকে নজর নেই। মেলা আর উত্সব করেই তো লক্ষ লক্ষ টাকা ধ্বংস করা হচ্ছে।”
বিজেপির জেলা সভাপতি তুষার মুখোপাধ্যায়েরও কটাক্ষ, “সরকারের বর্ষপূর্তি পালন করে সরকারি অর্থের অপচয়ই করা হচ্ছে। কেউ প্রতিবাদ করলে মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, ‘উত্সব করব না তো কি শ্রাদ্ধ করব’। ভাবা যায়!”
তৃণমূল অবশ্য এ সব অভিযোগে কান পাততে নারাজ। দলের এক জেলা নেতা বলছেন, “এই অনুষ্ঠান সামাজিক উন্নয়নেরই অঙ্গ। বিরোধীদের কুত্সা-অপপ্রচারের জবাব সাধারণ মানুষই দেবেন। ওরা পুরভোটে একটা জবাব পেয়েছে! আগামী বিধানসভা ভোটেও পাবে।”
জেলা রাজনীতির পর্যবেক্ষকদের মতে, রাজ্যে কোনও শিল্প আসছে না। তৈরি হচ্ছে না কর্মসংস্থানের নতুন ক্ষেত্র। তার উপর রাজনৈতিক সংঘর্ষ এবং আইনশৃঙ্খলা সমস্যা দেখা দিচ্ছে রাজ্যের নানা প্রান্তে। এই পরিস্থিতিতে সরকারের বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠান নিয়ে প্রশাসনিক মহলেও নানা মত রয়েছে। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা প্রশাসনের এক কর্তা বলছেন, “পরিষ্কার ভাবে বললে এই অনুষ্ঠান হবে উন্নয়নের প্রচার করতে। চার বছরে কী হয়েছে, আরও কী পরিকল্পনা রয়েছে, তা মানুষকে জানাতে।’’ অন্য এক আধিকারিকের আবার মত, “এ নিয়ে বিতর্কের কী আছে? সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। এতজন লোকশিল্পী যোগ দেবেন। এদের একটা রোজগারের সুযোগও তৈরি হল। এটা তো ভাল দিক।’’