এখানে থেমো না...। আরজি করের ঘটনার প্রতিবাদে শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে ‘রাত দখল’। বুধবার। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।
সিজার নম্বর ৩— ডায়েরির সাদা পাতা। তাতে নীল কালিতে লেখা, ‘খুব আনন্দে থাকো’!
হস্তাক্ষরটি কার? কী উদ্দেশ্যেই বা লেখা হয়েছে?
আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসক পড়ুয়াকে খুন এবং ধর্ষণের ঘটনায় পুলিশের তৈরি সিজার তালিকা সামনে আসার পরে এই প্রশ্ন উঠছে। সূত্রের খবর, ঘটনার রাতের যে ‘সময় সারণি’ প্রাথমিক ভাবে জানা গিয়েছে, তার সঙ্গে মিলিয়ে এই লেখা খতিয়ে দেখছে সিবিআই। সিজার তালিকায় থাকা সাদা পাতায় লেখা আরও কয়েকটি বিষয় আলাদা করে দেখছে তারা। যার মধ্যে রয়েছে, সাদা পাতায় লেখা সোদপুর থেকে ব্যারাকপুর পর্যন্ত মৃতার চেম্বার সংক্রান্ত নানান তথ্য। এ ব্যাপারে হস্তাক্ষর বিশারদের (গ্রাফোলজিস্ট) সাহায্য সিবিআই নিচ্ছে বলে সূত্রের খবর। দেখা হচ্ছে, ঘটনার রাতে ২টো ৩ মিনিটে মৃতার ফোন থেকে তাঁর এক আত্মীয়কে পাঠানো সংক্ষিপ্ত একটি হোয়াটসঅ্যাপ বার্তাও।
কী বোঝা যেতে পারে এই লেখা দেখে? বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে হস্তাক্ষর বিশ্লেষণের কাজে যুক্ত কলকাতার ‘ক্লিনিক্যাল গ্রাফোলজিস্ট’ স্বপনকুমার চন্দ্র বললেন, ‘‘হস্তাক্ষরটি কার, তা বলে দিতে পারেন হস্তাক্ষর বিশারদ। তদন্তে এমন বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেওয়া হয় প্রায়ই। ক্লিনিক্যাল গ্রাফোলজি বলে দিতে পারে, এই লেখাটি কী উদ্দেশ্যে বা কোন পরিস্থিতিতে লেখা হয়েছে। লেখার সময়ে যিনি লিখছেন, তাঁর উপরে কোনও চাপ ছিল কি না বা জোর করে লেখানো হয়েছে কি না, তা-ও জানা যেতে পারে। এমনকি, ক্লিনিক্যাল গ্রাফোলজিতে বলে দেওয়া যেতে পারে কোনও উদ্দেশ্যসাধনের জন্য কিছু লেখানো হয়েছে কি না!’’ স্বপন জানান, যে কোনও হাতের লেখা স্নায়ুনির্ভর। ফলে স্নায়ুর দুর্বলতা দেখা দিলে তার প্রভাবে হাতের লেখা বদলে যেতে পারে। মানসিক উৎকণ্ঠার চিহ্নও থাকে হাতের লেখায়। তবে এর সঙ্গেই পারিপার্শ্বিক তথ্যপ্রমাণ মিলিয়ে দেখে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হয়।
এই পরিপ্রেক্ষিতে তদন্তকারীদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে এখনও পর্যন্ত সামনে আসা, ঘটনার রাতের ‘সময় সারণি’। মৃতার মায়ের বয়ান অনুযায়ী, সে রাতে ১১টা ১৫ মিনিটে তাঁর সঙ্গে শেষ বার কথা হয় মেয়ের। সেই সময়ে মেয়ে খুব হাসিখুশি ছিলেন বলে মায়ের দাবি। কী খাবারের অর্ডার দিয়েছেন জানিয়ে, মাকে তিনি শুয়ে পড়তে বলেন বলে জানা গিয়েছে। সেই সময়ে এ-ও জানিয়েছিলেন, তিনি খেয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করবেন। মৃতার বন্ধু, যাঁর সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছিল বলে জানা গিয়েছে, তিনি দাবি করেছেন, রাত সাড়ে ১১টার আশেপাশে এক বার তাঁর সঙ্গে ফোনে কথা হয় তরুণীর। কিন্তু তিনি ব্যস্ত রয়েছেন জানানোয় বেশি ক্ষণ কথা হয়নি। এরপর ওই বন্ধু হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ করলেও উত্তর পাননি।
প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশ জানিয়েছিল, মৃতা অনলাইনে অর্ডার দেওয়া খাবার পেয়ে গিয়েছিলেন রাত সাড়ে ১২টা নাগাদ। সেমিনার রুম-এ চার জন জুনিয়র চিকিৎসককে নিয়ে তিনি সেই খাবার খেয়েছিলেন। সেই সময়ে অলিম্পিক্সে নীরজ চোপড়ার ‘জ্যাভলিন থ্রো’-ও দেখেছিলেন। তবে মৃতার মা দাবি করেছেন, খেলা দেখায় তাঁর মেয়ের কোনও আগ্রহ ছিল না। ফলে প্রশ্ন, জ্যাভলিন থ্রো দেখলেন, অথচ মায়ের সঙ্গে আর কথা এগোলেন না? বন্ধুর মেসেজের উত্তর দিলেন না? মৃতার মায়ের কথায়, ‘‘মেয়ে কখনও খেলা দেখত না। বসে বসে জ্যাভলিন থ্রো দেখল, আর ওকে (মেয়ের বন্ধুর নাম করে) মেসেজের কোনও উত্তর দিল না, এটা মানতে পারছি না।’’
রাত ২টো ৩ মিনিটে মৃতার ফোন থেকে এক আত্মীয়কে পাঠানো হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। মৃতার বাবার দাবি, ‘‘আমার এক ভাগ্নে এক জনের জন্য কোনও সার্টিফিকেটের ব্যবস্থা করে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। মেয়ের ফোন থেকে সেই উত্তরেই দেখছি, ‘না রে’ লিখে মেসেজ করা হয়েছে। ওই মেসেজের উত্তর দিল অথচ, ওকে (মেয়ের বন্ধুর নাম উল্লেখ করে) কিছু লিখল না? ’’ সূত্রের খবর, রোমান হরফে লেখা এই হোয়াটসঅ্যাপ বার্তাও খতিয়ে দেখছে সিবিআই। আঙুলের ছাপে খুলে ফেলা যায়, তরুণীর এমন মোবাইল ফোন অন্য ভাবে এই মেসেজ পাঠাতে ব্যবহার করা হয়েছিল কি না, খতিয়ে দেখা হচ্ছে। মৃতার মা বললেন, ‘‘রাতের ডিউটি থাকলে খাওয়ার পরে বহু ক্ষণ মেয়ে ফোনে আমার সঙ্গে কথা বলত। সে রাতেই কেন কোনও কথা হল না? আমার তো সেখানেও রহস্য ঠেকছে।’’