রাজ্যের দাবি, এখন প্রায় ২১ লক্ষ মহিলা বিধবা পেনশন পাচ্ছেন। ১ কোটি ৭৫ লক্ষ মহিলা উপভোক্তা পাচ্ছেন লক্ষ্মীর ভাণ্ডার। ২ কোটি ৩৩ লক্ষ স্বাস্থ্যসাথী, ৭৭ লক্ষ কন্যাশ্রী, ১৫ লক্ষ রূপশ্রী এবং প্রায় ২ কোটি ৩৫ লক্ষ সংখ্যালঘু ছেলেমেয়ে ঐক্যশ্রী বৃত্তি পেয়েছেন।
ফাইল চিত্র।
বাজেটে ঘোষণার সঙ্গে নতুন প্রকল্পের বরাদ্দ এবং রূপায়ণে মিল খুঁজে পায়নি দেশের কন্ট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি)। তাদের গত কয়েক বছরের রিপোর্ট জমা পড়েছে রাজ্য বিধানসভায়। ২০২০-২১ আর্থিক বছরের রিপোর্ট অনুযায়ী, সরকারি প্রকল্পের ঘোষণা এবং পরিচালনায় সেই ‘ফাঁক’ খুঁজে পাওয়ার দাবি করেছে সিএজি। যদিও, রাজ্য সরকার এই রিপোর্টের সঙ্গে একমত নয়।
প্রশাসনের এক কর্তার কথায়, “কোভিড কালে সবচেয়ে বেশি জরুরি ছিল, মানুষের হাতে নগদের জোগান দেওয়া। অর্থনীতি এবং জীবন-জীবিকার স্বার্থে সেই কাজ নিপুণ ভাবে করেছে সরকার। তাই লক্ষ্মীর ভান্ডারের মতো প্রকল্প চালু হয়েছে।”
প্রশাসনিক পর্যবেক্ষকদের অনেকেই মনে করিয়ে দিচ্ছেন, যে সময়ের ঘোষিত প্রকল্প নিয়ে সিএজি তাদের পর্যবেক্ষণ জানিয়েছে, তখন কোভিড-ধাক্কায় বহু ক্ষেত্র নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিল। ফলে সরকারের লক্ষ্য ছিল, সেই ক্ষেত্রগুলিকে আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে চাঙ্গা করা। ঘটনাচক্রে, তার পরে (২০২১) রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনও ছিল।
মূলত, আটটি সরকারি প্রকল্পের বিশ্লেষণ করা হয়েছে সিএজি রিপোর্টে। তফসিলি জাতিভুক্ত মানুষদের জন্য ‘বন্ধু’ প্রকল্প ঘোষণা করেছিল রাজ্য। বাজেট বক্তৃতা অনুযায়ী, তার জন্য ২৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়। এতে অন্য কোনও পেনশনের আওতায় না থাকা ৬০ বছরের বেশি উপভোক্তাকে মাসে ১০০০ টাকা পেনশন দেওয়ার কথা ছিল। সিএজির বিশ্লেষণ, প্রস্তাবিত ২৫০০ কোটি বরাদ্দের সাপেক্ষে ৭৬৭ কোটি টাকা ধার্য করা হয়েছিল। শতাংশের হিসেবে তা ৩১%। রিপোর্ট বলছে, ওই প্রকল্পে প্রস্তাবিত বরাদ্দের ৪৬% বা ১১৪৭ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। ধার্য হওয়া ৭৬৭ কোটির অতিরিক্ত (১১৪৭-৭৬৭) ৩৮০ কোটি টাকা রাজ্য এসসি, এসটি এবং ওবিসি আর্থিক উন্নয়ন নিগমের বাজেট-ঋণের মাধ্যমে পূরণ করা হয়েছে।
তফসিলি জনজাতিভুক্ত (এসটি) মানুষদের জন্য ‘জয় জোহর’ প্রকল্পের ঘোষণা করেছিল রাজ্য। তাতে ৬০ বছরের বেশি বয়সের মানুষ, যিনি অন্য কোনও সামাজিক পেনশনের আওতায় নেই, তাঁকে মাসে ১০০০ টাকা বার্ধক্য ভাতা দেওয়া হবে। প্রকল্পের জন্য বাজেটে ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু সিএজি-র পর্যবেক্ষণ, প্রস্তাবিত বরাদ্দের সাপেক্ষে কোনও অর্থ প্রদান করা হয়নি। যদিও প্রকল্পে ২০৬ কোটি টাকা খরচ করেছে সরকার।
ক্ষুদ্র-ছোট ও মাঝারি উদ্যোগগুলিকে (এমএসএমই) আর্থিক সহায়তার জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিল রাজ্য। প্রশাসনিক পর্যবেক্ষকেরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, কোভিড-কালে ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোগগুলিকে সহযোগিতার জন্যই প্রধানত এই প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। যদিও সিএজি তার রিপোর্টে জানাচ্ছে, সহায়তা চেয়ে ৭০টি উদ্যোগ আবেদন করার পরেও রাজ্য ২০২০-২১ আর্থিক বছরে কোনও অর্থ তাদের দেয়নি। বিনামূল্যে সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প নিয়ে সিএজি-র বিশ্লেষণ, বাজেটে ৫০০ কোটি টাকা প্রস্তাবিত বরাদ্দের কথা বলা হলেও, বাস্তবে ৩৬৮ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছিল। তার মধ্যে ১৯২ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে, যা প্রস্তাবিত বরাদ্দের ৩৮%। বেকায় যুবক-যুবতীদের ছোট ঋণ ও ভর্তুকিপ্রদানের জন্য কর্মসাথী প্রকল্পের আওতায় বাজেটে ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছিল সরকার। বাস্তবে তা ছিল ২৫ কোটি টাকা। ব্যবহৃত হয়েছে ০.২২ কোটি টাকা, যা প্রস্তাবিত বন্টনের ০.০৪%!
বাজেটে চা-সুন্দরী প্রকল্পের জন্য ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব থাকলেও বাস্তবে তা ছিল ১৬ কোটি টাকা। প্রকল্পে খরচ করা অর্থের পরিমাণ ০.৪৩%, যা প্রস্তাবিত বরাদ্দের ০.০১%। ১০০টি নতুন এমএসএমই পার্ক তৈরির জন্য রাজ্যের বাজেটে ২০০ কোটি টাকা প্রস্তাবিত বরাদ্দ ছিল। বাস্তবে বরাদ্দ হয় ৫৭৩ কোটি টাকা। কিন্তু ৬৬ কোটি টাকা ব্যবহৃত হয়েছে এ কাজে, যা প্রস্তাবিত বরাদ্দের ৩৩% মাত্র। গরিব পরিবারে বিনামূল্যে বিদ্যুৎ দেওয়ার জন্য ‘হাসির আলো’ প্রকল্পে ২০০ কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দের প্রস্তাব থাকলেও খরচ হয়েছে ২৭০ কোটি টাকা।
প্রশাসনের এক কর্তার বক্তব্য, “অতিরিক্ত সব খরচের হিসেব বিধানসভায় পাশ করানো হয়েছে। যেখানে যেমন প্রয়োজন, সেখানে তেমন ব্যয় করা হয়েছে। কোথাও কোনও গরমিল নেই। পুরোটাই স্বচ্ছতার সঙ্গে হিসেব রক্ষিত হয়েছে।”
তবে রাজ্য সরকারের বক্তব্য, সামাজিক ক্ষেত্রে চাহিদা মতো বহু পদক্ষেপ করা হয়েছে। দুর্বল বা আর্থিক ভাবে পিছনে থাকা মানুষদের সহযোগিতায় প্রায় ৪০০টি কর্মসূচি চলছে রাজ্যে। জোর রয়েছে মহিলা-ক্ষমতায়ন, বয়স্ক, বিধবা, তফসিলি জাতি-জনজাতি, বয়ঃসন্ধিতে থাকা মেয়েদের ক্ষমতায়নে। ‘জয় বাংলা’-প্রকল্পের সবক’টি কর্মসূচিকে এক ছাতার তলায় আনার কাজ চলছে। এর স্বীকৃতি হিসেবে 'ওয়েস্ট বেঙ্গল বিল্ডিং স্টেট ক্যাপাবিলিটি ফর ইনক্লুসিভ সোশাল প্রটেকশন'-এর আওতায় প্রায় এক হাজার কোটি টাকা ঋণ দিতে সম্মত হয়েছে বিশ্ব ব্যাঙ্ক। রাজ্যের দাবি, এখন প্রায় ২১ লক্ষ মহিলা বিধবা পেনশন পাচ্ছেন। ১ কোটি ৭৫ লক্ষ মহিলা উপভোক্তা পাচ্ছেন লক্ষ্মীর ভাণ্ডার। ২ কোটি ৩৩ লক্ষ স্বাস্থ্যসাথী, ৭৭ লক্ষ কন্যাশ্রী, ১৫ লক্ষ রূপশ্রী এবং প্রায় ২ কোটি ৩৫ লক্ষ সংখ্যালঘু ছেলেমেয়ে ঐক্যশ্রী বৃত্তি পেয়েছেন।