বোরহাটে পুকুর থেকে উদ্ধার হওয়া কৌটো। ছবি: উদিত সিংহ
যত দিন গড়াচ্ছে, ততই টের পাওয়া যাচ্ছে জঙ্গি-জালের বিস্তৃতি ও গভীরতা। খাগড়াগড়-কাণ্ডে এ বার গ্রেফতার করা হল এমন এক জনকে, যার বাড়ি বর্ধমানের ওই বিস্ফোরণস্থল থেকে প্রায় চার হাজার কিলোমিটার দূরে! এবং তাকে গ্রেফতার করা হল ঘটনাস্থলের প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার দূর থেকে।
ওই বিস্ফোরণ কাণ্ডের যোগসূত্রে এত দিন বিদেশি বলতে খোঁজা হচ্ছিল বাংলাদেশের নাগরিকদের। সাজিদ ওরফে শেখ রহমতুল্লা নামে এক জন বাংলাদেশিকে ইতিমধ্যেই গ্রেফতার করা হয়েছে। এ বার মায়ানমারের এক নাগরিককে গ্রেফতার করল জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)।
খালিদ মহম্মদ নামে ২৮ বছরের ওই যুবককে সোমবার দুপুরে হায়দরাবাদ থেকে গ্রেফতার করা হয়। এনআইএ সূত্রের খবর, মায়ানমার ও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী কয়েকটি এলাকায় খালিদ জঙ্গি শিবির চালাত। সে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন-এর সঙ্গে যুক্ত এবং আইইডি (ইম্প্রোভাইজ্ড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) ও বিস্ফোরক তৈরিতে বিশেষজ্ঞ। গোয়েন্দারা বলছেন, খালিদের সঙ্গে আইএসআইএস-এর যোগাযোগের প্রাথমিক প্রমাণ তাঁরা পেয়েছেন এবং এই বিষয়টি তাঁদের ভাবিয়ে তুলেছে।
এনআইএ জানায়, খালিদ বেশ কিছু দিন ধরে পরিচয় ভাঁড়িয়ে, জাল নথিপত্র জোগাড় করে হায়দরাবাদে ঘাঁটি গেড়ে ছিল। অন্ধ্রপ্রদেশ না হলেও সদ্যোজাত তেলঙ্গানা রাজ্যের সঙ্গে খাগড়াগড় বিস্ফোরণের যোগ থাকার সন্দেহ আগেই করেছিল এনআইএ। তদন্তকারীদের একাংশ জানান, ফেব্রুয়ারি মাসে করিমনগরের একটি ব্যাঙ্ক থেকে লুঠ হওয়া ৪৬ লক্ষ টাকার একাংশ খাগড়াগড়ে ঘাঁটি গেড়ে থাকা জঙ্গিদের হাতে সম্ভবত পৌঁছেছিল।
শুধু অন্ধ্রপ্রদেশ ও তেলঙ্গানা নয়, খাগড়াগড়ের তদন্তে তামিলনাড়ু এবং জম্মু ও কাশ্মীরেও যাবে এনআইএ।
এনআইএ-র বক্তব্য, খালিদের গ্রেফতারিতে খাগড়াগড় বিস্ফোরণের সূত্রে হদিস পাওয়া জঙ্গি মডিউল বা গোষ্ঠীর সঙ্গে বিভিন্ন দেশের সন্ত্রাসবাদীদের যোগাযোগের বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত হল। ২ অক্টোবর খাগড়াগড়ে হওয়া বিস্ফোরণের তদন্তে নেমে গোয়েন্দাদের একাংশ সন্দেহ করেছিলেন, ওই কাণ্ডের কুশীলবদের সঙ্গে আল-কায়দা ও পাক-তালিবান জঙ্গিদের যোগাযোগ রয়েছে। এনআইএ-র দাবি, ধৃত খালিদ জানিয়েছে, সে তেহরিক-ই-আজাদি-আরাকান নামে একটি জঙ্গি সংগঠনে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এবং তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান-এর সদস্যেরা এসে সেখানে জেহাদি প্রশিক্ষণ দিয়ে গিয়েছিল।
বোরহাটের পুকুরে তল্লাশি চালিয়ে ৫ কৌটৌ পিকরিক অ্যাসিড উদ্ধার করে এনআইএ। মঙ্গলবার তোলা নিজস্ব চিত্র।
এনআইএ সূত্রের খবর, খালিদের সঙ্গে জঙ্গি সংগঠন জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)-এর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। খাগড়াগড় বিস্ফোরণ সূত্রে হদিস পাওয়া জঙ্গি গোষ্ঠীর সদস্যদের খালিদ প্রশিক্ষণ দিয়েছিল কি না এবং পশ্চিমবঙ্গের কোথায় সে কবে গিয়েছে ও কার সঙ্গে দেখা করেছে, তা এনআইএ খতিয়ে দেখছে। খালিদকে শীঘ্রই কলকাতায় আনা হতে পারে। খালিদের কাছ থেকে জঙ্গি প্রশিক্ষণ এবং আইইডি ও বোমা তৈরির পদ্ধতি, এমনকী বিষ তৈরির প্রণালী সংক্রান্ত ভিডিও টেপ ও কাগজপত্র, আইএসআইএস-সহ বিভিন্ন জেহাদি সংগঠনের নথিপত্র উদ্ধার করা হয়েছে। ডিজি শরদ কুমারের নেতৃত্বে এনআইএ-র চার সদস্যের একটি দল এখন বাংলাদেশে। সূত্রের খবর, বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের কাছে কয়েকটি নাম ও ১০-১৫টি ফোন নম্বর দিয়েছেন তাঁরা।
বিস্ফোরক-বিশেষজ্ঞ খালিদকে হায়দরাবাদ থেকে গ্রেফতার করার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই খাগড়াগড়ের বিস্ফোরণ স্থল থেকে আধ কিলোমিটার দূরে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরক পিকরিক অ্যাসিড উদ্ধার করেছে এনআইএ। মঙ্গলবার বোরহাটে রবীন্দ্র ভবনের পাশে একটি দিঘি থেকে পাঁচ কৌটো ভর্তি ওই রাসায়নিক-বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়।
বীরভূম থেকে ধৃত, কীর্ণাহারের বাসিন্দা আমজাদকে সঙ্গে নিয়ে এ দিন বিধাননগর থেকে বর্ধমানে যায় এনআইএ-র একটি দল। আমজাদই ওই পুকুরটি দেখিয়ে দেয় তদন্তকারীদের। তার পর স্থানীয় কয়েক জন মৎস্যজীবীকে দিয়ে পুলিশ তল্লাশি চালিয়ে কৌটোগুলি উদ্ধার করা হয়। জালও ফেলা হয়েছিল।
প্রসঙ্গত, খাগড়াগড়ের ওই ডেরায় বিস্ফোরক ও আইইডি তৈরির কাঁচামাল তথা রাসায়নিক সরবরাহের মূল দায়িত্ব আমজাদেরই ছিল বলে গোয়েন্দারা জেনেছেন। খাগড়াগড়ে পিকরিক অ্যাসিডের মতো উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরক ব্যবহার করে আইইডি তৈরি করা হচ্ছিল জেনে গোয়েন্দারা তাজ্জব হয়ে যান।
এ দিন বোরহাটে যাওয়ার আগে আমজাদকে নিয়ে খাগড়াগড়ের কিছুটা দূরে জিটি রোডের উপর কেশবগঞ্জ চটি এলাকায় একটি দোকানে হানা দেন এনআইএ অফিসারেরা। ওই দোকানের মালিক পুলক সাধু জানান, মাস চারেক আগে সাত হাজার টাকা ভাড়ায় ওই দোকানটি নিয়েছিল আমজাদ। সেখানেই এই ধরনের অ্যাসিড মজুত করত সে। তবে আশপাশে গাড়ির যন্ত্রাংশ ও হার্ডঅয়্যারের বিভিন্ন দোকান থাকায় কারও সন্দেহ হয়নি। আমজাদ ধরা পড়ার পরে অ্যাসিড ভর্তি ৩০টিরও বেশি ওই ধরনের কৌটো কাছেই বোরহাটের ওই পুকুরে ফেলে দেন পুলকবাবু। দোকানঘরটি অন্যকে ভাড়াও দিয়ে দেন। এনআইএ যদিও পুকুর থেকে পাঁচটির বেশি কৌটো পায়নি। তদন্তকারীদের দাবি, জলে থেকে ওই রাসায়নিক এত দিনে নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়ার কথা।
এনআইএ-র অন্য একটি দল এ দিন বীরভূম জেলার মহম্মদবাজারের দেউচা হাইস্কুলে যায়। খাগড়াগড় বিস্ফোরণের একমাত্র জীবিত প্রত্যক্ষদর্শী, দেউচা গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল হাকিম ওই স্কুল থেকেই মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিল। তবে সে পাশ করতে পারেনি বলে এনআইএ জেনেছে। গোয়েন্দারা ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেন, স্কুলছাত্র হিসেবে হাকিম সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করেন।