ব্রিগেডের সভায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। রবিবার সুদীপ্ত ভৌমিকের তোলা ছবি।
এক ঝলক দেখে মনে হবে, তিনি সত্যিই বৃদ্ধ হলেন! শুভ্রকেশের নীচে গালে ধবধবে দাড়ি। সিঁড়ি দিয়ে নামার গতি ঈষৎ শ্লথ। ব্রিগেডের মঞ্চ থেকে নামতে নামতে প্রকাশ কারাটকে ইশারায় বলে গেলেন, পার্টি অফিসে আসতে। কথা আছে। দু’হাতে ভিড় ঠেকিয়ে নিরাপত্তারক্ষীরা গাড়িতে তুলে দিলেন তাঁকে।
চেহারায় কর্মী-সমর্থকদের কাছে আনকোরা তো বটেই, ভূমিকাও এ বার সম্পূর্ণ নতুন। সেই নয়া ভূমিকা পালন করেই রবিবার বিকালে ব্রিগেড ময়দান ছাড়লেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। আগের মতো আর মুখ্য বক্তা নন! বরং, ব্রিগেডের সভাপতি হিসাবে বক্তাদের নাম ডাকছেন। শুরুতে কয়েক লাইন এবং সব শেষে আরও কয়েক লাইন, দু’দফায় সংক্ষিপ্ত কিন্তু চোখা বক্তব্য। এই নতুন ভূমিকা পালন করার ফাঁকেই বুদ্ধবাবু বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন, দলে জমানা বদলাচ্ছে। নেতৃত্বের ব্যাটন হস্তান্তর হতে চলেছে। আর তিনি নিজে চলে যাচ্ছেন উপদেষ্টার ভূমিকায়।
বুদ্ধবাবুর প্রায় আধা-অবসরের পথে এগিয়ে যাওয়ার মতোই আরও একটি বার্তা থেকে গেল সিপিএমের রবিবাসরীয় ব্রিগেডে। উচ্চকিত কোনও ঘোষণা ছাড়াই! যখন সমাবেশের সর্ব শেষ বক্তা হিসাবে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের নাম ডাকলেন বুদ্ধবাবু। চিরাচরিত প্রথা অনুযায়ী, সিপিএমের ব্রিগেডে শেষ বক্তাই মুখ্য আকর্ষণ এবং তিনিই দলের মুখ। বরাবর যে ভূমিকায় জ্যোতি বসুকে দেখত ব্রিগেড জনতা। বসুর অসুস্থতার সময় থেকে সেই ভূমিকায় এত দিন ছিলেন বুদ্ধবাবুই। এ বার বক্তাদের ক্রম-তালিকা থেকেই ইঙ্গিত বেরিয়ে এল, ধারাবাহিক রক্তক্ষরণের রোগে আক্রান্ত রাজ্য সিপিএমের প্রধান মুখ হিসাবে উঠে আসছেন এক চিকিৎসকই!
বেশ কয়েক বছর ধরেই শারীরিক কারণে কলকাতার বাইরে দলের কোনও বৈঠকে যেতে পারেন না বুদ্ধবাবু। তবুও এত দিন দলের পলিটব্যুরো এবং কেন্দ্রীয় কমিটিতে রেখে দেওয়া হয়েছে তাঁকে। এ বার রাজ্য সম্মেলন এবং পার্টি কংগ্রেসের আগে দলের কাছে বুদ্ধবাবুর জোরালো আবেদন, কোনও কমিটিতেই তাঁকে রাখা যাবে না! সেই আর্জি সম্ভবত পুরোটা মানা হচ্ছে না এ বারও। বুদ্ধ-ঘনিষ্ঠ এক পলিটব্যুরো সদস্যের কথায়, “উনি বলছেন আর থাকবেন না। আমরা বলেছি বটে সেটা হয় না। কিন্তু কোনও বৈঠকে যেতে পারেন না, এটাও তো সত্যি। শেষ পর্যন্ত পলিটব্যুরো, কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে হয়তো অব্যাহতিই দিতে হবে এ বার। তবে রাজ্য কমিটি এবং সম্পাদকমণ্ডলীতে তাঁকে থাকতে হবে।” সিপিএমের রাজ্য নেতৃত্বেরও একই মত।
বুদ্ধবাবু যখন নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছেন মুখ্যত পরামর্শদাতার ভূমিকায়, তখনই দলে আবার ছায়া লম্বা হচ্ছে বিরোধী দলনেতা সূর্যবাবুর। রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু থাকা সত্ত্বেও এ বার একের পর এক জেলা সম্মেলন উদ্বোধনের ভার পড়েছিল সিপিএমের এই পলিটব্যুরো সদস্যের উপরে। তাতেই যে ইঙ্গিত ছিল, এ দিন ব্রিগেডে শেষ বক্তা হিসাবে তাঁর বলতে ওঠা সেই আভাসকে আরও একটু স্পষ্ট করেছে। শেষ মুহূর্তে বড় কোনও অঘটন না ঘটলে আগামী শুক্রবার, দলের ২৪ তম রাজ্য সম্মেলনের শেষ দিন বিমানবাবুর হাত থেকে রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্বের ব্যাটন সূর্যবাবুর হাতেই উঠে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা।
অঘটনের কথা তবু মাথায় রাখতে হচ্ছে বিশেষ পরিস্থিতির কারণেই। রাজ্য সম্পাদক হলে সিপিএমে সূর্যবাবুই হবেন জ্যোতিবাবুর পরে দ্বিতীয় ব্যক্তি, যিনি একই সঙ্গে বিরোধী দলনেতা এবং দলের সাংগঠনিক শীর্ষ পদ সামলাবেন। জ্যোতিবাবুর সেই ‘রেকর্ড’ সূর্যবাবুর হাতে যাক, এখনও চায় না দলের একাংশ। তাদের বাধার মুখে পড়ে শেষমেশ আবার বিমানবাবুর নামেই সিলমোহর পড়ে স্থিতাবস্থা থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা অল্প হলেও এখনও আছে। এমনকী, সূর্যবাবু নিজেও কিঞ্চিৎ কুণ্ঠিত আছেন বলে সিপিএম সূত্রের খবর! কিন্তু পলিটব্যুরোর এক সদস্য বলছেন, “এই অবস্থায় সম্পাদক না বদলালে কর্মী মহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে। এতগুলো জেলায় সম্পাদক পরিবর্তন করে আসার পরে রাজ্যে কেন পারা গেল না, তার জবাব দেওয়াও কঠিন হবে। তাই যা হওয়ার, এ বারই হয়ে যাওয়া উচিত!” করণীয় কাজ মসৃণ ভাবে সম্পন্ন করার লক্ষ্যেই আজ, সোমবার থেকে শুরু হওয়া সম্মেলনে উপস্থিত থাকছেন কারাট, ইয়েচুরি, মানিক সরকারেরা।
আকর্ষণীয় তথ্য হল, পাঁচ দিনের সম্মেলন শেষে নতুন কারও হাতে ব্যাটন উঠলে এ রাজ্যে এই প্রথম সিপিএমে সম্পাদক বদল হবে! সেই ১৯৬১ সালে জ্যোতিবাবুর হাত থেকে রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়েছিলেন প্রমোদ দাশগুপ্ত। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টি তখন অবিভক্ত। তার পর থেকে প্রমোদবাবু, সরোজ মুখোপাধ্যায়, শৈলেন দাশগুপ্ত, অনিল বিশ্বাস এঁরা সকলেই সম্পাদক হয়েছেন পূর্বসূরির মৃত্যুতে। এমনকী, বিমানবাবুও সম্পাদক পদে এসেছিলেন অনিলের প্রয়াণে তৈরি হওয়া শূন্যস্থানেই। সেই অর্থে এ বারই প্রথম রাজ্য সম্পাদকের পরিবর্তন হবে! বিদায়ীর হাত থেকে দায়িত্ব নেবেন নবীন।
এই হাত বদলে যেমন একটা ‘যদি’ এখনও বাকি, তেমনই আর এক ‘যদি’র লক্ষ্যে লড়াইও এ দিন থেকে তীব্রতর হল! শেষ পর্যন্ত এ রাজ্য থেকে পলিটব্যুরোয় আসন খালি হলে এ বার প্রথম দাবিদার মহম্মদ সেলিম।
দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং ‘সুবক্তা’ সাংসদ এ দিন ব্রিগেডে খেললেনও একেবারে ঝোড়ো ভঙ্গিতে! বাংলার সঙ্গে হিন্দির মিশেলে মোদী এবং দিদিকে বিঁধে জনতাকে চাঙ্গা করার কাজটা করলেন
সেলিমই। “মেহেদি পাতা পাওয়া যায়, তার রং সবুজ। কিন্তু বেশি কচলালে লাল হয়ে যায়। এই বাংলাতে তা-ই হবে!” এই উপমায় শেষ করে মঞ্চ থেকে নামামাত্র কর্মী-সমর্থকদের ভিড়ে সেলিমের বন্দি হয়ে যাওয়া কারাট-ইয়েচুরিদের নজর এড়ায়নি। দরের এক রাজ্য নেতা বলেই ফেললেন, “সংসদে এক দিন ভুল হয়ে যাচ্ছিল। মধ্যরাতে যেটা বুদ্ধদেবকে সামলাতে হয়েছিল। সে দিনের পাপস্খালন করে নিলেন সেলিম!”