জয়দেব মেলায় ঢল নামতে শুরু করল মঙ্গলবার থেকেই। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী
চার দশকের রেওয়াজে ছেদ টেনে জয়দেব মেলার উদ্বোধন হল মকরসংক্রান্তির আগের দিন, মঙ্গলবারই।
মকর সংক্রান্তির ভোরে অজয়ে নদে পূণ্যস্নান ও শতাব্দী প্রাচীন রাধাবিনোদ মন্দিরে পুজো দেওয়ার ঢল নামে। দশকের পর দশক ইলামবাজারের কেঁদুলিতে জয়দেব মেলার প্রথাগত সূচনা এ ভাবে হলেও, সরকারি ভাবে মেলার সূচনা এতদিন হত মকর সংক্রান্তির দিন বিকেলে। সেই প্রথা বদলে মকরসংক্রান্তির আগের দিনই মেলার উদ্বোধন করার প্রশাসনের এই পদক্ষেপকে ইতিবাচক হিসাবেই দেখছেন মেলায় মেলায় আগত মানুষজন। প্রশাসন সূত্রে খবর, সরকারি মেলা আরও ভাল করে পরিচালনার জন্য ও মেলায় আগত মানুষকে বিব্রত না করার জন্যই মিলিত ভাবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকারি মেলা কমিটি।
কথিত আছে, কবি জয়দেব প্রতি বছর মকর সংক্রান্তিতে মকরস্নান করতে যেতেন কাটোয়ার গঙ্গায়। এক বার তিনি এমন অসুস্থ হয়ে পড়েন যে এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। রাতে তিনি স্বপ্ন দেখেন তাঁর জন্য মা গঙ্গা উজান বেয়ে অজয় নদে এসে মিলিত হবেন। তাই অজয় নদে স্নান করলেই গঙ্গাস্নানের ফল পাবেন জয়দেব। এই কাহিনির বিস্তারেই কেঁদুলির মেলাকে বাঙালি উৎসর্গ করেছে কবি জয়দেবের স্মৃতি তর্পণে। তার জেরেই রাজ্যে ও দেশের নানা প্রান্ত থেকে পূণ্যস্নানের জন্য মেলায় আসেন বহু মানুষ। প্রশাসনের হিসেবে, লক্ষ লক্ষ
মানুষের সমাগম হয়। মেলামুখী জনস্রোত শুরু হয় মকর সংক্রান্তির আগের দিন থেকেই। অর্থাৎ কাগজে কলমে মেলা শুরু হওয়ার আগের দিন থেকেই। প্রশাসন সূত্রে খবর, উদ্বোধনের দিন বদলে সেই দিকটাকেই মাথায় রাখা হয়েছে।
জয়দেব মেলা কমিটির সম্পাদক তথা বোলপুরের মহকুমাশাসক অভ্র অধিকারী জানাচ্ছেন, কাগজে কলমে মকর সংক্রান্তির দিন মেলার উদ্বোধন হলেও, তার আগের দিন থেকে পূণ্যস্নানের জন্য হাজার হাজার মানুষ জয়দেবে পৌঁছে যান। কার্যত মেলা শুরু হয়ে যায়। তাঁর কথায, ‘‘যখন মেলার উদ্বোধন হয়, তখন মকরস্নান সেরে অনেকে বাড়ির পথে পা বাড়িয়েছেন। তাই উদ্বোধন তো আগেই করা উচিত, তাই না?’’ মহকুমাশাসকের সংযোজন, ‘‘এ ছাড়া মকর সংক্রান্তির দিন বিকেলে যখন মেলা উদ্বোধনের জন্য বিশিষ্ট অতিথিবর্গকে আনা হতো মেলা প্রাঙ্গণে তখন মেলামুখী ভিড়ের জন্য সমস্যাও হতো। মানুষও বিব্রত হতেন। সেসব এড়াতেই মেলা কমিটির মিলিত ভাবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে মেলা পরিচালনায় সুবিধে হবে।’’
সরকারি ভাবে জয়দেব মেলা অধিগ্রহণের আগে এ মেলা পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন জয়দেব রাধাবিনোদ মন্দিরের মহান্তরা। কিন্তু ফি বছর মেলায় ক্রমবর্ধমান মানুষের নিরাপত্তা ও জল বিদ্যুতের মতো পরিষেবা দেওয়া, মেলার সমগ্রিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য প্রশাসনিক নজরদারি জরুরি বলে এ ব্যাপারে উদ্যোগী হন তৎকালীন বাম সরকারের কৃষি ও সমবায় মন্ত্রী তথা ভক্তিভূষণ মণ্ডল। ১৯৮১ সালে জয়দেব মেলা পরিচালনার দায়িত্ব নেয় বীরভূম জেলা প্রশাসন ও জেলা পরিষদ। তারপর থেকে চার দশক ধরে জয়দেব মেলা সফল ভাবে পরিচালনা হয়ে আসছে সরকারি উদ্যোগেই। মেলার সভাপতি খোদ জেলাশাসক।
এ বারে উদ্বোধন এগিয়ে আসাকে ইতিবাচকভাবেই দেখছেন স্থানীয়রা। জয়দেব অঞ্চল সংস্কৃতি পর্ষদের এক সদস্য, স্থানীয় বাসিন্দা আনারুল হক বলছেন, ‘‘নিজের ছন্দে জয়দেব মেলা শুরু মকরস্নানকে দিয়েই। আগে মকরসংক্রান্তির দিন বিকেলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের উদ্বোধন হত। এখন মেলার উদ্বোধন হয়। তবুও মানুষের সুবিধার কথা ভেবে উদ্বোধন এগিয়ে আনায় খুশি।’’ দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে মেলায় আসা কবি সমরেশ মণ্ডল বলছেন, ‘‘বৈষ্ণব তীর্থক্ষেত্র জয়দেব। জেলার অন্যতম বড় মেলা। প্রচুর মানুষ আসেন। গ্রামীণ মেলার আদলে তেমন বদল না হলেও মানুষের সচেতনতা, স্বাচ্ছন্দ্যবোধ বেড়েছে। সেদিক থেকে অনেক ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রশাসন।’’
প্রশাসন জানাচ্ছে, সরকারি ভাবে মেলা পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার থেকে আমূল বদলেছে মেলা পরিচালনার ধরন। রাধাবিনোদ মন্দির সংলগ্ন রাস্তার দুপাশে মেলার অসংখ্য স্টল বসত একসময়। অগ্নিকাণ্ডের আশঙ্কা এড়াতে ও জনসধারণকে স্বস্তি দিতে এখন কয়েকশো স্টল ও আখড়া-সহ কার্যত গোটা মেলাই সরিয়ে নেওয়া হয়েছে অজয়ের বালির চরে। শুধু মকরস্নান ও রাধাবিনোদ মন্দিরে পুজো দেওয়া এবং মেলায় ঘোরা নয়, জয়দেব কেঁদুলির মেলায় উপরি পাওনা, বিনা খরচে আখড়ায় থাকা-খাওয়া, কীর্তন ও বাউলের সুরে মজে থাকা। এত সংখ্যক মানুষের সমাগমে কোনও অনভিপ্রেত ঘটনা যাতে না ঘটে, মেলা যাতে সুষ্টু ভাবে সম্পন্ন হয় সেটাই লক্ষ্য থাকে প্রশাসনের। মেলা এগিয়ে নিয়ে আসায় তাতে সুবিধে হবে বলেই মনে করছেন প্রশাসনের কর্তারা।