ধর্মান্তর আটকাতে বাঁধ হল ব্রাহ্মসমাজ

ভবনটির সামনের পাঁচিলটা ভেঙে ফেলা হয়েছে। ভিতরে আগাছা কেটে সিমেন্ট দিয়ে বাঁধিয়ে দেওয়া হয়েছে উঠোন।

Advertisement

সুস্মিত হালদার

কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০১৮ ০৭:১০
Share:

—ফাইল চিত্র।

ভবনটির সামনের পাঁচিলটা ভেঙে ফেলা হয়েছে। ভিতরে আগাছা কেটে সিমেন্ট দিয়ে বাঁধিয়ে দেওয়া হয়েছে উঠোন। কেমন যেন রাতারাতি ঝকঝকে হয়ে উঠেছে চারধারটা।

Advertisement

এতদিন যাঁরা প্রায় ভগ্নস্তূপে পরিণত হওয়া বাড়িটার দিকে ফিরেও দেখতেন না, আজ সেই সব পথচলতি মানুষদের অনেকেই থমকে দাঁড়াচ্ছেন ভবনের সামনে। জানতে চাইছেন। শহরের মানুষের মনে তৈরি হচ্ছে কৌতূহল।

ক’দিন আগেও এই ভবনটি নেহাতই ভগ্নস্তূপের ভুতুড়ে বাড়ি বলে পরিচিত ছিল সাধারণ শহরবাসীর কাছে। নামমাত্র কয়েকজন হয়তো জানতেন এই বাড়ির ইতিহাস। কিন্তু সে ভাবে কোনওদিনই চর্চা হয়নি শহরে। অথচ, এই বাড়িটার সঙ্গে জড়িয়ে আছে নানান গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির সুসন্তান শ্রীশচন্দ্র রায়ের নাম।

Advertisement

মূলত তারই উদ্যোগে কৃষ্ণনগর শহরে শুধুমাত্র ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল তা নয়, বাংলার অন্যতম সাংস্কৃতিক প্রাণকেন্দ্র বলে পরিচিত কৃষ্ণনগর শহরে ব্রাহ্মসমাজের এক জোয়ার এসেছিল। সেই জোয়ার পরবর্তী কালে আছড়ে পড়েছিল বিধবা বিবাহ, শিক্ষা বিস্তারের মতো সামাজিক আন্দোলনের ক্ষেত্রেও। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় ছিলেন বাংলার হিন্দুধর্মের অন্যতম নেতা। তাঁরই দাপটে প্রবল বৈষ্ণবায়নের সময়েও বাংলায় শাক্ত-আচার প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। অথচ, তাঁরই বংশধর রাজা শ্রীশচন্দ্র রায় সেই রাজবাড়িতেই প্রথম নিরাকার উপাসনার জন্য ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করলেন। সালটি ১৯৪৮। রাজা রামমোহন রায়ের পরবর্তী কালে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর-সহ অন্যদের হাত ধরে দ্বিতীয় পর্যায়ের ব্রাহ্মধর্ম আন্দোলন শুরু হয়েছে। সেই আন্দোলনে সক্রিয় ভাবে জড়িয়ে পড়লেন শাক্ত রাজপরিবারে কট্টর হিন্দু সংস্কৃতির মধ্যে বেড়ে ওঠা রাজা শ্রীশচন্দ্র রায়।

তিনিই দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে আনিয়েনিলেন ব্রাহ্মধর্মের নিয়মাবলী। তাতে স্বাক্ষর করলেন ব্রজনাথ মুখোপাধ্যায়, নীনমণি গড়গড়ি, কার্তিকেয়চন্দ্রের মতো ব্যক্তিরা। কলকাতা থেকে একজন ব্রাহ্মধর্ম প্রচারককে পাঠালেন কৃষ্ণনগরে। এরই মধ্যে ৪০ থেকে ৫০ জন ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন। কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে প্রতিষ্ঠা হল ব্রাহ্মসমাজ। সেই সঙ্গে প্রতি বুধবার উপাসনা হতে থাকে।

ওই বছরই রাজবাড়ির কাছেই প্রতিষ্ঠিত হল ব্রাহ্মসমাজ মন্দির। জমি দিলেন রাজা শ্রীশচন্দ্র রায়। মন্দির তৈরির খরচ বহন করলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরে অবশ্য শ্রীশচন্দ্র ব্রাহ্মধর্ম বিস্তারের ক্ষেত্রে উৎসাহ হারিয়ে ফেলতে থাকেন। কিন্তু তাতে কৃষ্ণনগর শহরে ব্রাহ্মধর্মের বিস্তার থেমে থাকে না। বরং বহু মানুষই যাঁরা সরাসরি ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত না হয়েও ব্রাহ্মসমাজের নানান সমাজ সংস্কারমূলক কাজের সঙ্গে জড়িয়ে যেতে লাগলেন। শিক্ষা বিস্তারের পাশাপাশি বিধবা-বিবাহ আন্দোলন শুরু হল জোর কদমে।

সক্রিয় ভাবে অংশ নিতে থাকলেন রামতনু লাহিড়ী, ব্রজনাথ মুখোপাধ্যায়, কার্তিকেয়চন্দ্র রায়েরা। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে কেশবচন্দ্র সেন, বিদ্যাসাগরের মতো ব্যক্তিদের পায়ের ধুলো পড়েছে এই ব্রাহ্মসমাজের মন্দিরে। যদিও শ্রীশচন্দ্র রায়ের ব্রাহ্মসমাজের প্রতি এই পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ।

কৃষ্ণনগর শহরের বাসিন্দা লেখক সুবীর সিংহরায় বলছেন, “সেই সময় কৃষ্ণনগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় খ্রিষ্ট মিশনারিজদের সক্রিয়তায় অনেক হিন্দু খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করতে শুরু করেছেন। মিশনারিজদের সেই ধর্মান্তকরণ আটকাতে শ্রীশচন্দ্র সম্ভবত ব্রাহ্মসমাজকে বাঁধের মতো ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। তিনি নিজে কিন্তু ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করলেন না।” তিনি বলেন, “পরে যখন দেখলেন যে ব্রাহ্মসমাজকে দিয়ে মিশনারিজদের আটকানো যাচ্ছে না, ধর্মান্তকরণ চলছেই, তখন তিনি ব্রাহ্মসমাজে উৎসাহ হারান।”

তবে যে কারণেই হোক না কেন, তাঁরই উৎসাহে কৃষ্ণনগর শহরে ব্রাহ্মসমাজের প্রতি যে উৎসাহ-উদ্দীপনা তৈরি হয়েছিল, যে সমাজসংস্কারের জোয়ার এসেছিল, তার প্রভাব পৌঁছে গিয়েছিল তৎকালীন সমাজের গভীরে। এর ফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। কৃষ্ণনগর তথা নদিয়া জেলার সমাজজীবনকে নানা ভাবে প্রভাবিত করতে থাকল এই ব্রাহ্মসমাজ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement