আমার পড়শি

নিঃসঙ্গ আমি, পড়শি কেবল বই

যখন নিজের বাড়ি বানানো হচ্ছিল, তখন কিচ্ছুটি না জেনেও আমি মাঝে-মাঝে নির্মাণ কাজের তদারকির জন্য বসে থাকতাম। যারা আমার পড়শি হবেন, সেই বাড়িতে গৃহনির্মাণের অনেক মালমশলা রাখা হয়েছিল। সেই আম-কাঁঠাল গাছে ছায়াচ্ছন্ন বাড়ির প্রবীণ মহিলা নাতনির হাত দিয়ে আমার জন্য কফি পাঠিয়ে দিতেন। আমরা পাড়া-পড়শি নিয়েই বসবাস করতাম।

Advertisement

অশ্রুকুমার সিকদার

শেষ আপডেট: ২৮ জুন ২০১৫ ০২:০৯
Share:

যখন নিজের বাড়ি বানানো হচ্ছিল, তখন কিচ্ছুটি না জেনেও আমি মাঝে-মাঝে নির্মাণ কাজের তদারকির জন্য বসে থাকতাম। যারা আমার পড়শি হবেন, সেই বাড়িতে গৃহনির্মাণের অনেক মালমশলা রাখা হয়েছিল। সেই আম-কাঁঠাল গাছে ছায়াচ্ছন্ন বাড়ির প্রবীণ মহিলা নাতনির হাত দিয়ে আমার জন্য কফি পাঠিয়ে দিতেন। আমরা পাড়া-পড়শি নিয়েই বসবাস করতাম। মাঝরাতে মার পেটে অসহ্য যন্ত্রণা হলে পড়শি যুবক ঘুম চোখে উঠে এসে মাকে ইঞ্জেকশন দিয়ে যেত। বাড়িতে রং করার আয়োজন হলে ছবি-আঁকিয়ে প্রতিবেশী কোথায়, কেমন রং হবে সেই বিষয়ে পরামর্শ দিতেন। আবার কোনও পড়সির দেয়ালে আমার বাড়ির গাছের শাখা গিয়ে পড়লে তিনি বিরক্তি জানাতেন। এক সহকর্মী প্রতিবেশী আমার ছোট মেয়েকে পায়ের পাতার উপরে বসিয়ে দোল্ দোল্ দোলাতেন। আর গল্প করতেন। আমার স্ত্রীর বড় অসুখের সময়ে তিনি সর্বতোভাবে আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু, তিনি পড়শি মাত্র ছিলেন না, তিনি ছিলেন বন্ধু। আর এক পড়শি ছিলেন এক বিধবা মহিলা। তাঁর ছোট্ট বাড়িটি ঘিরে চিল গাছ-গাছালি ভরা অনেকটা জমি। অনেক গাছ। কিছু ফুলের। কিছু ফুলের নয়। তিনি গাছের যত্ন করতেন, সামান্য সাংসারিক কাজ করতেন আর অনেক রাত অবধি জেগে রেডিয়োয় নানান দেশের খবর শুনতেন।

Advertisement

সেই বাড়িশুদ্ধ জমি বিধবা মহিলার ছেলেমেয়েরা বেচে দিল। উৎখাত হয়ে গেল বৃক্ষলতাগুলো। সেই জমিতে গড়ে উঠল এক বহুতল আবাসন-জটিলতা। বিতর্কহীন মালিকানার সব পুরানো বাড়ি ভেঙে বহুতল উঠে যাচ্ছে চারদিকে। নানা দিক দেশ থেকে আসা মানুষেরা, পরস্পর অচেনা মানুষেরা এই সব ফ্ল্যাটে-ফ্ল্যাটে, কবুতরের কোপে বসবাস করেন। যে জমিতে দশজনও থাকত না, সেই জমির উপর দিয়ে উদ্ধত মাথা তোলা ভবনে শতাধিক মানুষ বাস করেন। অনেক মানুষ, কেউ কাউকে চেনেন না। সুতরাং পাড়া-পড়শির ব্যবস্থা লোপ পাবার মুখে। আবাসনের মানুষেরাও পরস্পরকে জানেন না, সিঁড়িতে দেখা হলে বড়জোর সৌজন্য-নমস্কার বিনিময় হয়। আর পাড়ার পুরনো লোকেদের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ গড়ে ওঠে না। মার্কিন সমাজতাত্ত্বিকের একটা বইয়ের নাম অনুযায়ী পাড়ায় এখন পড়শি নেই, আছে ‘লোনলি ক্রাউড’ (lonely crowd)। সবাই নিজের ফ্ল্যাটের মধ্যে নিঃসঙ্গ, একা; রাস্তা দিয়ে জনপ্রবাহ বয়ে যায়, কেউ কাউকে জানে না, চেনে না। পড়শি অবলুপ্তির পথে।

এক ছাত্র দিয়েছিল দুটি দেবদারু গাছ। জানালা দিয়ে সেই দেবদারু গাছের দিকে চেয়ে থাকি। যখন প্রথম সবুজ পাতা বের হয়, তখন প্রাণের বিস্ময়কর জাগরণে অভিভূত হয়ে যাই। দূরের নারকেল গাছের আন্দোলিত পাতার দিকে তাকিয়ে থাকি। রোজই ভোরবেলা ফুল চুরি হয়ে যায় বটে, তবু আমার পড়শি টগর ও কামিনী ফুলের গাছদুটি আছে জেনে ভাল লাগে। ছাদে গোলাপ, জবা, রঙ্গন ফোটে, নির্দিষ্ট সময়ে বোগেনভেলিয়ার লতা ফুলে-ফুলে ঐশ্বর্যশালী হয়ে ওঠে। আমি ততো প্রকৃতির প্রেমে পড়ি। বয়সের কারণে শরীর অশক্ত হয়ে যাওয়ায় চলার ক্ষমতা কমে গিয়েছে। অনেক বন্ধুই কালের নিয়মে আর নেই। সেই বন্ধুর কথা বিশেষ করে মনে পড়ে, যাঁর ইচ্ছে ছিল, সল্ট লেকের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে দূরে কোনও নাম না জানা নদীর স্রোতের কল্লোল শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়বে। এক বন্ধু মোটা কাচের চশমা পড়ে বইয়ের উপর আতস কাঁচ রেখে এখনও বঙ্কিমচর্চা করে চলে। আর এক বন্ধু কবিতা লেখে এবং তরুণ কবিদের প্রকাশনায় সাহায্য করে। এক বন্ধু জার্মানি থেকে স্বরচিত কবিতা পড়ে শোনায়। একটি বিতর্কিত বিষয়ের এখন আমি মনোযোগী ছাত্র। তাতে আমাকে সাহায্য করছে তিনজন মহিলা। সবটাই ফোনে।

Advertisement

এখন অনেকটাই নিঃসঙ্গ আমি। চুপচাপ বসে থাকা আমার সবচেয়ে বড় পড়শি। ছোটবেলায় পড়েছিলাম ধীরেন্দ্রলাল ধরের ‘কামানের মুখে নানকিং’ ও ‘আফ্রিদি সীমান্তে’। বসুমতী বা ভারতবর্ষ পত্রিকা থেকে তিমিরবরণের লেখা উদয়পথের সহযাত্রী, হেমেন্দ্রকুমার রায়ের যখের ধন এবং আবার যখের ধন। কার্ল মার্ক্সের একট ছোট জীবনী পড়ে ভেবেছিলাম বন্ধুত্ব হতে হবে মার্কস-এঙ্গেলসের মত। আরও একটু বড় হয়ে কবিতায় মেতে গেলাম। তখন আই এ পড়ি। পকেট গড়ের মাঠ। তবু কিনে ফেললাম এলিয়টের নির্বাচিত কবিতা। সে বছরই এলিয়ট নোবেল পান। আঁতিপাঁতি করে পড়লাম কবিতাগুলি। রবীন্দ্রনাথ তো পড়তামই, তার সঙ্গে জায়গা করে নিল এলিয়ট। এক দাদা স্থানীয় মানুষ হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ও আবু সঈদ আয়ুব সম্পাদিত আধুনিক বাংলা কবিতা পড়তে দিয়ে আমাকে তাতিয়ে দিলেন। এখনও কানে বাজে বিষ্ণু দে-র ‘ক্রেসিডা’ কবিতার ছন্দতরঙ্গ। এখনও মনে পড়ে আশুতোষ বিল্ডিঙের চারতলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে শেষ সন্ধ্যার নির্জনতায় আমি আন্দ্রে জিদ-এর ‘ফ্রুটস অব দি আর্থ’ পড়ছি। আর মনে পড়ে কয়েক মাস যখন ঘোর অপছন্দের কেন্দ্রীয় সরকারের এক দফতরে কাজ করছিলাম, তখন পনেরো দিন ধরে দস্তয়েভস্কির ‘ব্রাদার্স কারামাজভ’ পড়া। আমি যেন পারিপার্শ্বিক সব ভুলে গিয়েছিলাম। রাস্তায় চলাচল করতাম, কাজের দফতরে যেতাম, বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতাম, কিন্তু সবই যেন অলীক। একমাত্র বাস্তব দমিত্রি, নিকোলাই, গ্রুশেঙ্কা আর আলোয়েশা। বইয়ের প্রতি পাগলের মতো ভালবাসার কারণে, আমি যখন কলেজে চাকরি নিলাম, তখন যেচে কলেজ লাইব্রেবি গড়ার দায়িত্ব নিলাম। তখন তো সস্তাগন্ডার দিন। আমি অধ্যক্ষকে গিয়ে বলতাম, কলকাতা যাচ্ছি, কলেজ লাইব্রেরির জন্য তিন হাজার টাকার বই নিয়ে আসি। বিদ্যোৎসাহী, আমার প্রতি স্নেহশীল সেই অধ্যক্ষ ঈষৎ হেসে বলতেন, ‘‘পাঁচ হাজার টাকার বেশি আনবেন না যেন।’’ আমি কলেজ স্ট্রিটে দাশগুপ্ত কোম্পানির দোতলায় গিয়ে বই বেছে দিয়ে আসতাম। তাই এই মফঃস্বলের কলেজ লাইব্রেরিতে মেলে হানা আরেন্ড-এর ‘অরিজিনস অব টোটালিটেরিয়ানিজম’, সার্ত্র-কামুর বই, মেলে ডয়েৎশারের তিন খণ্ড ট্রটস্কির জীবনী, কার্ল জাসপার্স-এর দার্শনিক বই, ইভো আন্দ্রিচ-এর উপন্যাস।

বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়তে গেলাম তখন ক্লাসের পরেই বিভাগ ছেড়ে চলে যেতাম গ্রন্থাগারে। বই-ই আমার বন্ধু, বই-ই আমার পড়শি, তাই গ্রন্থাগারিকেরা আমার বন্ধু হয়ে তো উঠলেনই, বন্ধু হয়ে উঠলেন চতুর্থ শ্রেণির কর্মীরাও। তাঁরাই তাক থেকে খুঁজে খুঁজে দরকারি বই আমার হাতে তুলে দিতেন। এই গ্রন্থাগার থেকে এমন অনেক বই আমি পড়েছি, যে বই অন্য কোনও পাঠক আগে ধার নেননি। যেমন রিলকে বিষয়ে একটি চমৎকার স্মৃতিকথা আমার আগে অপঠিত ছিল। ইয়োরোপিয় সাহিত্যের চমৎকার সংগ্রহ ছিল এখানে। আর এই লাইব্রেরিকে কেন্দ্র করেই ইতিহাসের প্রতি আমার আগ্রহ জন্মায়। আমি সাহিত্যের পাশাপাশি ইতিহাস পড়তে শুরু করি।

ধীরে ধীরে বাংলা ও ইংরেজি মিলিয়ে আমারও একটি নিজস্ব বইয়ের সংগ্রহ গড়ে ওঠে। কলকাতার গ্র্যান্ড হোটেলের তলায় একটি বিদেশি বইয়ের দোকান ছিল। সেই দোকানের সামনে আমি অধ্যাপক সুশোভন সরকারকে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে বই পড়তে দেখেছি। সেই দোকান থেকে বেশ কিছু বই আমি কিনেছিলাম, যেমন লিশম্যান অনূদিত রিলকের কবিতার বই। বাংলায় কবিতার বইয়ের একটি সংগ্রহ গড়ে উঠল এক আলমারি ছাপিয়ে। তাতে যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, জীবনানন্দ থেকে কে নেই, রাহুল পুরকায়স্থ, সেবন্তী ঘোষ পর্যন্ত। একটা রিভিয়ু পড়েছিলাম, এক গুরুজন কিছু টাকা দিলেন। হিলকার্ট রোডের দোকান থেকে কিনে ফেললাম মার্কেজের ‘ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিটিউড’। পরে ক্রমাগত সংগ্রহ করতে থাকলাম শুধু মার্কেজ নয়, কার্পেন্তিয়ের ও লাতিন আমেরিকার অন্যান্য লেখকদের বই। ইসাবেল আয়েন্দেও আমার প্রিয় লেখক, কিন্তু জানি না কেন তিনি ততো খ্যাতনাম্নী নন। উপহার পাই, ভালবেসে পড়ি রামকুমারের বই, অমর মিত্র আর বিপুল দাসের কথাসাহিত্য। দেশভাগের ইতিহাস নিয়ে, হিন্দু-মুসুলমান সম্পর্ক নিয়ে পড়ি ইতিহাসের বই।

সভা-সমিতি ছেড়ে দিয়েছি, নিতান্ত নিরুপায় না হলে বাড়ির বাইরে যাই না। নিঃসঙ্গ, একা মানুষ আমি। স্বজনেরা থাকা সত্ত্বেও ভিতরে-ভিতরে একা। একা মানুষের পড়শি নিজের কেনা, ধার করে আনা বই। কিন্তু যে মানুষের চোখ দু’টি গ্লুকোমায় আক্রান্ত, সারা দিনে যাকে চোখে আটবার ওষুধের ফোঁটা দিতে হয়, যাঁর বাবা শেষ জীবনে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন, এই শেষ পড়শি বই-ও তার পাশে শেষ অবধি থাকবে কি!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement