Jadavpur University

ওরা থাকে ওধারে! পাঁচিলে ঘেরা যাদবপুর এক ভিন্ন গ্রহ, বাইরে ক্রমে বাড়লেও ভিতরে ফোটে না পদ্মফুল

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনকে যাঁরা ধারাবাহিক ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন, তাঁদের অনেকের বক্তব্য, আরএসএস বা বিজেপি যে ক্যাম্পাসে পা রাখার চেষ্টা করেনি তা নয়। কিন্তু ‘ব্যাটে-বলে’ হয়নি।

Advertisement

শোভন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৫ মার্চ ২০২৫ ০৮:৫৮
Share:
BJP has grown a lot in Jadavpur area politics in the last few years, but why they have no influence in the University campus

গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।

৬০ একর নিয়ে একটি ‘গ্রহ’। যে গ্রহের পাশ দিয়ে লোকাল ট্রেন যায়, বাস যায়, হলুদ ট্যাক্সি যায়, হেঁটে চলে যান মানুষ, চলে যায় কতশত মিছিল। কিন্তু ইথার তরঙ্গ ভেদ করে সেই গ্রহে ঢুকতে পারে না বাইরের কোনও কিছু। কিছু মিছিল নভোযান হয়ে সে গ্রহে পৌঁছোনোর চেষ্টা করে। পারে না। পাঁচিলে ধাক্কা খেয়ে ফিরতে হয়।

Advertisement

গ্রহের রং লাল। সেই লালের মধ্যে অবশ্য বিভাজন আছে। কোনও অংশ গাঢ় লাল। কোনও অংশ ফিকে। গাঢ়-ফিকের দ্বন্দ্ব সেই গ্রহের রোজনামচা। কিন্তু বাইরের কোনও রং ঢুকতে গেলে সব লাল মিশে যায়। তখন সব লাল এক এবং অভিন্ন।

গ্রহের নাম যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়।

Advertisement

পাঁচিলঘেরা ৬০ একরের ভিতরে এক ছবি। বাইরে আর এক। গত শনিবার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুকে কেন্দ্র করে যে ঘটনা ঘটেছিল, তার রেশ রয়েছে মঙ্গলবারেও। এর মধ্যেই সোমবার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় অভিমুখে মিছিল নিয়ে গিয়েছিল আরএসএসের ছাত্র সংগঠন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ (এবিভিপি)। কিন্তু অতীতের মতোই তাদের গেট থেকে ফিরে আসতে হয়েছে। বাম-রাম ছাত্র সংঘাত সবটা যে ‘নিরামিষ’ ছিল তেমনও নয়। কিন্তু গ্রহের ভিতর পৌঁছোতে পারেনি এবিভিপি।

আবার এই পাঁচিলের বাইরেই রয়েছে ‘বৃহত্তর’ যাদবপুর। যেখানে রয়েছে বাঘাযতীন, গাঙ্গুলিবাগান, সন্তোষপুর, বিজয়গড়, আজাদগড়, কুদঘাট, বাঁশদ্রোণী, টালিগঞ্জ, নেতাজিনগরের মতো এলাকা। সেখানে ছবিটা ভিন্ন। একদা এই সমস্ত জায়গায় বামেদের দুর্ভেদ্য দুর্গ ছিল। কিন্তু গত পাঁচ-সাত বছরে সেই বাম জমিতেই মাথা তুলেছে পদ্মশিবির। ভোট বেড়েছে বিজেপির। গত লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে যাদবপুর এবং টালিগঞ্জ বিধানসভায় তৃণমূলের পরে বিজেপিই দ্বিতীয়। অন্য এলাকার মতো বামেরা এখানে প্রান্তিক শক্তি নয় বটে। কিন্তু তারা তৃতীয় শক্তি।

বাইরে বাড়লেও পাঁচিলঘেরা যাদবপুরে বিজেপি ধাক্কা খাচ্ছে কেন? কেন বারংবার তাদের ফিরে আসতে হচ্ছে দুয়ার থেকে?

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনকে যাঁরা ধারাবাহিক ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন, তাঁদের বক্তব্য: আরএসএস বা বিজেপি যে ক্যাম্পাসে পা রাখার চেষ্টা করেনি তা নয়। ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে অবাংলাভাষীদের মধ্যে সংগঠন তৈরি করে তার ব্যাপ্তি বাড়ানোর চেষ্টা করেছিল এবিভিপি। কিন্তু তা ‘ব্যাটে-বলে’ হয়নি। তার কারণ হিসেবে প্রায় সকলেই পাঁচিলের ভিতরে যে ‘বাম বাস্তুতন্ত্র’ (লেফ্‌ট ইকোসিস্টেম) রয়েছে, তার উল্লেখ করছেন। যে বাস্তুতন্ত্রের মৌলিক জায়গা হল রাজনীতি এবং মতাদর্শ। যে বাস্তুতন্ত্রের সঙ্গে সরাসরি সংসদীয় গণতন্ত্র বা পাড়ার রাজনীতির কোনও সম্পর্ক নেই। অনেকে এ-ও মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, রাজ্যে যখন ভরা বাম জমানা, তখনও এই গ্রহের মধ্যে সিপিএমের ছাত্র সংগঠন এসএফআই নিশ্চিন্তে যে সব চালাতে পেরেছিল তা নয়। কারণ, সিপিএম তথা বামফ্রন্টের রাজনীতির সঙ্গে অনেক বাম সংগঠনের সরাসরি বিরোধিতা ছিল। বিতর্ক ছিল। সেই বিতর্ক আবর্তিত হয়েছে ‘সংশোধনবাদ’ এবং ‘বিপ্লবী হঠকারিতা’ নিয়ে। কিন্তু অক্ষুণ্ণ থেকে গিয়েছে বাম বাস্তুতন্ত্র।

কিন্তু পাঁচিলের বাইরের বৃহত্তর যাদবপুরের বিস্তীর্ণ অংশে রয়েছে উদ্বাস্তু কলোনি। যা বিজেপিকে মাথা তুলতে সাহায্য করেছে বলেই অভিমত বাম এবং পদ্মশিবিরের অনেকের। কেন উত্থান, কেন পতন, তা নিয়ে নানাবিধ মত রয়েছে। কিন্তু উদ্বাস্তু কলোনি যে বিজেপির জন্য ‘উর্বর’, তা মানছেন দু’পক্ষের প্রায় সকলেই। যে কলোনিতে একটা সময়ে ছিল সিপিএমের সংগঠন ইউসিআরসি-র ঘাঁটি, সেখানেই এখন অটো কিংবা বাস স্টপেজের নাম ‘ভারতমাতার মন্দির’ (এইটি বি থেকে গড়িয়ামুখী পথে সুলেখার পরের স্টপেজ)। ফলে বদল স্পষ্ট।

কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচিলের বাইরে থেকে ফিরতে হয় বিজেপিকে? কেন ক্যাম্পাসে পদ্মের ছাপ নেই? বিজেপি নেতা রাজর্ষি লাহিড়ীর বক্তব্য, ‘‘রাষ্ট্রের মদতে যাদবপুরে রাষ্ট্রবিরোধী শক্তি যুগ যুগ ধরে আধিপত্য কায়েম করে রেখেছে। কখনও তাকে মদত দিয়েছে জ্যোতি বসু বা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকার। এখন মদত দিচ্ছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকার।’’ তা হলে বাইরে কী ভাবে বাড়তে পারছে বিজেপি? রাজর্ষির বক্তব্য, ‘‘ভিতরে স্বৈরাচার রয়েছে। আর বাইরে কলোনি এলাকার মানুষ বুঝতে পারছেন কারা পূর্ববঙ্গে তাঁদের ভিটে কেড়েছিল। এ-ও বুঝতে পারছেন যে, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়েরা না থাকলে এখানে বাঙালি হিন্দুদের ঠাঁই হত না।’’ সিপিএমের তরুণ নেতা সৃজন ভট্টাচার্যের আবার বক্তব্য, ‘‘ক্যাম্পাসের ভিতরে যে তর্কের পরিসর রয়েছে, সেখানে বিজেপি খাপ খাওয়াতে পারে না। ওই ক্যাম্পাসে কেউ গরুর দুধে সোনা পাওয়ার তত্ত্ব শুনবে না। তা-ই বিজেপি পারছে না। পারবেও না।’’ আর বাইরে বিজেপির বৃদ্ধির কারণ? সৃজন দু’টি যুক্তি দিচ্ছেন। এক, উদ্বাস্তু এলাকায় মানুষের ভিটে হারানোর ক্ষতস্থানে ‘মেরুকরণের নুন’ ছেটানোর চেষ্টা করছে বিজেপি। তাই কিছুটা হলেও তারা বেড়েছে। এবং দুই, উদ্বাস্তু এলাকায় বামেদের যে লড়াই ছিল, প্রজন্ম বদলের পর অনেকের স্মৃতিতেই তা ফিকে হয়েছে। ফলে বামেরা আগের থেকে দুর্বল হয়েছে। সৃজনের দাবি, ‘‘এখনও যাদবপুর এলাকায় বামেদের শক্তি সংহত রয়েছে।’’

উল্লেখ্য, দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়েও (জেএনইউ) বাম ছাত্র সংগঠনগুলির সঙ্গে মূল লড়াই এবিভিপির। কিন্তু যাদবপুরের সঙ্গে জেএনইউ-এর মৌলিক পার্থক্য হল, যাদবপুরে এখনও এবিভিপি-কে থাকতে হচ্ছে ক্যাম্পাসের বাইরেই। আর দিল্লিতে তারা রয়েছে ক্যাম্পাসের ভিতরেও। আবার জেএনইউ-এর ভিতরে বামেদের যে দাপট, রাজধানীর মহল্লা রাজনীতিতে তার কোনও প্রভাব নেই। ফলে পাঁচিলঘেরা যাদবপুর যেমন বিজেপির কাছে ভিন্ন গ্রহ, তেমনই জেএনইউ-এর বামেদের কাছে পাঁচিলের বাইরের দিল্লিও ভিন্ন গ্রহ।

এ-ও বাস্তব যে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে শাসকদলের ছাত্র সংগঠন তৃণমূলও সে ভাবে দাগ কাটতে পারেনি। দফায় দফায় চেষ্টা করেও টিএমসিপি যাদবপুরে সংগঠনকে কোনও আকৃতি দিতে পারেনি। তবে ক্যাম্পাসের রাজনীতিতে ছাত্রদের মধ্যে প্রভাবকে যদি নিক্তিতে মাপা যায়, তা হলে পদ্মশিবিরের তুলনায় তৃণমূলের প্রভাব, দৃশ্যমানতা কিছুটা হলেও বেশি। কিন্তু বামেদের সামনে সেই শক্তি দাঁড়াতে পারে না। বিষয় ভিত্তিতে বামেরা কখনও আলাদা, কখনও এক। যা বিজেপি এবং তৃণমূলের কাছে ক্যাম্পাসের রাজনীতিতে খানিকটা গোলকধাঁধার মতো। আবার ক্যাম্পাসের ভিতরে যাঁরা বাম, মতাদর্শগত ভাবে যাঁরা বিজেপির বিরোধী, বাইরের রাজনীতির ক্ষেত্রে তাঁদের অনেকেই আবার ‘নো ভোট টু বিজেপি’ স্লোগানে পরোক্ষে তৃণমূলের পক্ষে। সেই অংশের আবেদন যে স্বভাবসিদ্ধ ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ অংশকে প্রভাবিত করে, তা-ও মানছেন সিপিএমের অনেকে। যা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচিলের বাইরের রাজনীতিতে বামেদের জন্য ‘নেতিবাচক’ প্রভাব তৈরি করছে।

বিজেপি যে বাংলার উদ্বাস্তু অধ্যুষিত এলাকায় মাথা তুলতে পারে, তা দেখা গিয়েছিল ১৯৯৯ সালের লোকসভা ভোটে। বাংলায় যখন বিজেপির ‘ব’ ছিল না, সেই সময়ে কৃষ্ণনগর এবং দমদম থেকে জিতেছিলেন বিজেপির সত্যব্রত মুখোপাধ্যায় এবং তপন শিকদার। ২০ বছর পরে ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে দেখা যায় সেই বিজেপি-ই এই সমস্ত এলাকায় (বিধানসভাভিত্তিক) কোথাও প্রথম, কোথাও দ্বিতীয় হয়ে উঠেছে। ২০১৯ থেকে পাঁচিলের বাইরের যাদবপুরেও একই ঘটনা দেখা গিয়েছিল। যা অব্যাহত থেকেছে ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটেও।

কিন্তু পাঁচিলের ভিতরে যেতে পারছে না তারা। ধাক্কা খেতে হচ্ছে দুয়ারেই। পাঁচিলঘেরা ৬০ একর এখনও এক ভিন্ন গ্রহ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement