অমিত শাহ।—ছবি পিটিআই।
জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) তৈরির হুঙ্কারই কাল হয়েছে। তিন বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে পরাজয়ের পর এ কথাই কবুল করল বিজেপি। একই সঙ্গে গোপন থাকল না যে, এই ধাক্কা তাদের কাছে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। দলের রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেন, ‘‘এই ফল হওয়ার কথা ছিল না। খড়্গপুর (সদর), কালিয়াগঞ্জ, করিমপুর— তিন বিধানসভা কেন্দ্রেই মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া পেয়েছিলাম। তার পরেও এই ফলের কারণ বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে! এনআরসি নিশ্চয়ই একটা প্রভাব ফেলেছে।’’ বিজেপির কালিয়াগঞ্জের প্রার্থী কমলচন্দ্র সরকার এবং করিমপুরের প্রার্থী জয়প্রকাশ মজুমদারও স্বীকার করেছেন, তাঁদের ভোটে কাঁটা হয়েছে এনআরসি।
বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি তথা দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বারে বারে হুঙ্কার দিচ্ছেন, দেশে এনআরসি হবেই। দিলীপবাবু ‘দু’কোটি বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’কে পদাঘাতে দেশান্তরী করার হুমকিও দিয়েছেন একাধিক বার। বিজেপির রাজ্য নেতারা লোকসভা ভোটের পর থেকে এনআরসি-র ভয় দেখিয়েছেন সংখ্যালঘু মুসলিমদের এবং বরাভয় দিয়েছেন হিন্দুদের। এর সঙ্গেই যুক্ত হয়েছে অসমে প্রায় ১২ লক্ষ হিন্দুর এনআরসি-ছুট হওয়ার অভিজ্ঞতা, সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া সে রাজ্যের ডিটেনশান ক্যাম্পের ছবি।
এনআরসি নিয়ে বিজেপির মোকাবিলায় তৃণমূল, বাম এবং কংগ্রেস ওই সব হুমকি ও অসমের অভিজ্ঞতাকে হাতিয়ার করায় নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল (সিএবি)-কে ঢাল করে বিজেপি। শাহ দলীয় নেতৃত্বকে বলেন, এনআরসি নয়, প্রচার করতে হবে সিএবি নিয়ে। ওই বিলই যে শরণার্থীদের ভরসা, তা বোঝাতে হবে পাড়ায় পাড়ায়। বৃহস্পতিবার তিন কেন্দ্রের উপনির্বাচনের ফল বেরনোর পরে বিজেপি নেতৃত্বের ঘরোয়া বিশ্লেষণ, সাংগঠনিক নির্বাচনে ব্যস্ততার জন্য সিএবি নিয়ে যথেষ্ট প্রচার করা যায়নি। ফলে মানুষ এনআরসি নিয়ে বিরোধীদের প্রচারে ‘বিভ্রান্ত’ হয়েছেন। এনআরসি-র ভয়ে সংখ্যালঘু মুসলিম ভোট তৃণমূলে গিয়েছে। আর লোকসভা নির্বাচনে বাম ভোটের কিছুটা গেরুয়া শিবিরে গেলেও এই উপনির্বাচনে তা গেছে তৃণমূলে। সেখানেও কাজ করেছে এনআরসি আতঙ্ক।
বিজেপির আর এক অংশের অবশ্য অভিমত, লোকসভা ভোটে ১৮টি আসন জয়ের পর দলের কেউ কেউ আত্মতুষ্টি এবং আত্মম্ভরিতায় ভুগতে শুরু করেছিলেন। এই ভোটে অভিজ্ঞ নেতাদের সকলকে ভাল ভাবে কাজেও লাগানো হয়নি। ফলে খড়্গপুরে এমন প্রার্থী বাছা হয়েছে, যাঁর সম্পর্কে দলের ভিতরে এবং আমজনতার মধ্যে অসন্তোষ ছিল। রাজ্য বিজেপি-র আরএসএস ঘনিষ্ঠ অংশের দাবি, কালিয়াগঞ্জ এবং করিমপুরে প্রার্থী চূড়ান্ত করার জন্য রাজ্য থেকে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে একাধিক নাম গিয়েছিল। কিন্তু খড়্গপুরের ক্ষেত্রে শুধু প্রেমচন্দ ঝা-র নামই পাঠানো হয়েছিল। দিলীপবাবু অবশ্য বলেন, ‘‘খড়্গপুরেও প্রার্থী বাছাই করার জন্য একাধিক নাম গিয়েছিল। আর প্রেমচন্দ ঝা-র নাম কেন্দ্রীয় নেতাদের সমীক্ষায় উঠে এসেছিল।’’
তবে খড়্গপুরে বিজেপির ফল মর্যাদার লড়াইয়ে দিলীপবাবুর পরাজয় বলে মনে করছে দলেরই একাংশ। কারণ তিনি সাংসদ হওয়ায় তাঁরই ছেড়ে যাওয়া আসনে উপনির্বাচন হয়েছে। সেখানে এই ফল রাজ্য সভাপতির আসন ধরে টান দেবে কি না, সে প্রশ্নও উঠে গিয়েছে দলের অন্দরে। এ নিয়ে দিলীপবাবুর প্রতিক্রিয়া, ‘‘দিলীপ ঘোষ পদ চায়ও না, পদ ছাড়েও না। আমি ছাড়া আর কারও লড়াইয়ের হিম্মৎ আছে? লড়াই করেছি, হেরেছি।’’
উপনির্বাচনের দিন একমাত্র জয়প্রকাশবাবুর নিগ্রহের ঘটনা ছাড়া আর কোনও বড় অশান্তির অভিযোগ বিজেপি তোলেনি। কিন্তু এ দিনের পরাজয়ের পরে রাজ্য বিজেপির কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক কৈলাস বিজয়বর্গীয় দায়ী করেছেন শাসক তৃণমূলের ‘বুথ দখল’কে। আর মুকুল রায় এর পরেও আশাবাদী, ‘‘উপনির্বাচন দিয়ে সাধারণ ভোটকে ব্যাখ্যা করা যায় না। ২০২১-এ বিজেপিই রাজ্যে সরকার গড়বে।’’