অনসূয়া সেন।
শিশুরা ঘুরে বেড়াচ্ছে রাস্তায়। ওদের মায়েরা রোজ ওদের একা ফেলে চলে যায়। লোকের বাড়ি কাজ করে ক’পয়সা উপার্জন। তা দিয়ে রাতের চুলো জ্বলে। কচি মুখগুলোর খিদের আগুন মেটে। আধা খালি, আধা ভরা পেটে শান্তির ঘুম নেমে আসে ফুটপাথে। সন্তানকে কোলে নিয়ে বসে থাকার মতো, আদরযত্ন দিয়ে লালন করার মতো বিলাসিতা ওদের পোষায় না।
এই সব শিশুর কারও গায়ে জামা আছে, কারও নেই। কারও চামড়ায় চড়া ধুলোর আস্তরণ। অপুষ্টি আর অযত্নের স্পষ্ট ছাপ। সকলের মধ্যে একটা ক্ষেত্রেই মিল। প্রত্যেকের পেটের খিদে।
আর তাই খাবারের লোভ দেখিয়েই ওদের ঘরে ডাকতেন তিনি। বাড়িতে বানানো গজা, নাড়ু, বাদামের চাকতি দিয়ে লোভ দেখাতেন। তার পর বাড়িতে বসিয়ে পড়াশোনা শেখানোর কাজটি সেরে ফেলতেন কোনও আয়োজন ছাড়াই।
তিনি অনসূয়া সেন। কল্যাণীর বাসিন্দা। প্রাক্তন স্কুল শিক্ষিকা। এবং তিনি চিকিৎসক-সমাজকর্মী বিনায়ক সেনের মা।
গল্পচ্ছলে উঠে আসে সেই সব পথশিশুর কথা। যারা দিদার কাছে খাবারের লোভে আসতে শুরু করলেও এক দিন শুরু হয় সত্যিকারের পড়াশোনা। দিদার কাছে আবদার আসতে থাকে, স্কুলে করানো জটিল অঙ্ক সহজ করে বুঝিয়ে এবং কষে দিতে শেখানোর।
তিনি এমনই। সারা জীবন সংসারের দায়িত্ব পালন করেছেন। স্বামীর অবসর জীবনের পর যোগ দিয়েছেন স্কুলে। শিক্ষিকা হিসাবে তৈরি করতে চেয়েছেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে। তবে শুধু প্রথাগত পড়াশোনা নয়, বরাবরই তিনি আসল শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চেয়েছেন ছোটদের। তাই হয়তো শিশুরা তাঁর সঙ্গে এত সহজ, প্রাণবন্ত। অনসূয়া জানান, একটা সময়ে, যখন শারীরিক সামর্থ্য ছিল, ওই ছোট বাচ্চাদের সঙ্গে লাফঝাঁপ করেছেন তিনিও। খেলার মধ্যে দিয়ে, প্রকৃতি চেনার মধ্যে দিয়ে, জীবনের শিক্ষার মধ্যে দিয়ে বড় করে তুলেছেন বাচ্চাদের।
দীর্ঘ তেরো বছর কল্যাণীর একটি স্কুলে শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বাহাত্তরে অবসর নেওয়ার পরে বাড়িতেই স্কুল শুরু করেন তিনি। দু’বছর বয়সি শিশুদের নিয়ে মেতে থাকেন সারা দিন। তাদের একটু একটু করে ফুটে ওঠার, সুগন্ধ ছড়ানোর জন্য প্রস্তুত করেন। কল্যাণীতে পারিবারিক পরিবেশে দিব্যি চলছে ওই প্রি-নার্সারি স্কুল। প্রায় ৩০ জন পড়ুয়া নিয়ে চলা ওই স্কুলের পড়ুয়া সংখ্যায় যদিও ধাক্কা লেগেছে নোটবন্দির সময়ে, জানান প্রৌঢ়া।
তবে তাতে তিনি দমে যাননি। আজও খুঁজে-খুঁজে পাড়ার শিশুদের বাড়িতে নিয়ে আসেন পড়াবেন বলে। আজও কারও কষ্ট দেখলে উতলা হয়ে পড়েন। ছেলের মতোই। কিংবা ছেলেই আসলে মায়ের মতো!
পুত্র বিনায়কও মায়ের কাজ নিয়ে উৎসাহিত। তাঁর থেকেই জানা গেল, অনসূয়ার ‘ঝালাই’ নামে একটি গানের দল রয়েছে। যে দল তৈরির ইতিহাস আবার মজার। কল্যাণী এলাকার বেশ কয়েক জন মহিলা মিলে গান বাজনা করতে আসতেন অনসূয়ার বাড়ি। সেখানে কোনও ভুলে যাওয়া গানের সুর স্বরলিপি খুঁজে বার করে তুলে নেওয়া হত। এমন ভাবেই একদিন তৈরি হল মেয়েদের গানের দল।
ছোটবেলায় মা মারা যায় অনসূয়ার। তখন তাঁর ছ’মাস বয়স। জেঠাইমার কাছে মানুষ হওয়া শিশুটি তখনও জানত না, মাত্র সাড়ে চার বছর বয়সেই বাবা তাকে নিজের কাছে এনে রাখবেন। মামা বাড়ির প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও বুঝে নিতে চাইবেন নিজের দায়িত্ব। স্ত্রী গত হওয়ার পরে দ্বিতীয় বিয়ে করেননি অনসূয়ার অ্যাডভোকেট বাবা। তিন মেয়েকে বড় করেছেন একাই। দায়িত্ব থেকে মুখ না ফেরানোর পাঠ বোধ হয় সে বয়সেই শুরু হয়ে গিয়েছিল মা-মরা মেয়েটির।
সেই পাঠ দিয়েছেন বিনায়ককেও। অনসূয়ার গলা এখনও কেঁপে ওঠে ছেলের কথা বলতে গিয়ে। তার পরেও জোর গলায় বলতে পারেন, এত কিছুর পরেও মানুষের কথা ভাবা বন্ধ করেননি ছেলে। তাঁর কথায়— ‘‘বিনায়ক এক দিন এখানে আসার পর ওকে বললাম, ‘আমার কাছে এসেছিস, আরও ক’টা দিন থেকে যা।’ ছেলে বলল— ‘মা, আমি যদি না ফিরি, তা হলে মাইলের পর মাইল পথ পায়ে হেঁটে, জঙ্গল পেরিয়ে, তোমার মতো বয়স্ক যে মহিলা আমায় দেখাতে আসবেন, তিনি ফিরে যাবেন। আর কোনও দিন চিকিৎসা করাতে আসবেন না। এটা তো আমি করতে পারি না।’ সে দিনই বুঝেছিলাম, আমি ওর মা হতে পারি, তবে আমার মতো আরও অনেক মায়ের জন্য আমার ছেলে ভাবে। কাজ করে।’’
চিকিৎসক পুত্র বিনায়ক এই মায়ের থেকেই শিখেছেন সহবত। পেয়েছেন মানুষের জন্য কাজ করার শিক্ষা। অনসূয়া জানাচ্ছেন তিনি সমাজসেবামূলক কোনও সংগঠনের সঙ্গে কোনও দিনই যুক্ত ছিলেন না। খাতায়কলমে কোনও দিন সমাজসেবী হিসাবে কাজও করেননি। তিনি যা করেছেন, তা করে থাকেন বাড়ির মা-মাসিরা। কোনও নিরন্ন মানুষ বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়ালে মুখে ভাত তুলে দিয়েছেন। কোনও অসুস্থ-দরিদ্র মানুষের চিকিৎসার প্রয়োজন হলে উদ্যোগী হয়েছেন।
কারণ, ভাল থাকা তো সকলের অধিকার। আর অনসূয়া বলছেন, একা একা ভাল থাকা যায় না। ভাল থাকতে গেলে এক জন, দুই জন, তিন জন করে সকলকে ভাল রাখতে হয়। তবেই নিজে ভাল থাকা সম্ভব।
তিনি বিনায়ক সেনের মা। আগামির বিনায়কেরাও এই শিক্ষাই পাচ্ছেন তাঁর কাছে। এখন তাঁর বয়স বিরানব্বই। তবু তাঁর মানুষ তৈরির কারখানা চলছে।