নথির নাগাল না দিয়ে বাধা পুলিশই

সারদা কেলেঙ্কারির তদন্তে নেমে কেন্দ্রীয় এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) হাইকোর্টে নালিশ জানিয়েছিল, তদন্তের কাজে বিধাননগর পুলিশ তাদের কাঙ্খিত সহযোগিতা করছে না। কয়েক মাস বাদে একই অভিযোগ আরও বড় চেহারা নিয়ে ফিরল। এ বার অভিযোগকারী কেন্দ্রীয় সরকারেরই আর এক সংস্থা সিরিয়াস ফ্রড ইনভেস্টিগেশন অফিস (এসএফআইও)। সারদা-কাণ্ডে নিজস্ব তদন্ত সেরে তারা কেন্দ্রকে সম্প্রতি যে রিপোর্ট জমা দিয়েছে, তাতেই বলা হয়েছে, রাজ্য পুলিশ তথা বিধাননগর কমিশনারেটের অসহযোগিতার ফলে প্রতি পদে কী ভাবে হোঁচট খেতে হয়েছে তদন্তকারীদের।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০১৪ ০৪:৩৫
Share:

সারদা কেলেঙ্কারির তদন্তে নেমে কেন্দ্রীয় এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) হাইকোর্টে নালিশ জানিয়েছিল, তদন্তের কাজে বিধাননগর পুলিশ তাদের কাঙ্খিত সহযোগিতা করছে না। কয়েক মাস বাদে একই অভিযোগ আরও বড় চেহারা নিয়ে ফিরল। এ বার অভিযোগকারী কেন্দ্রীয় সরকারেরই আর এক সংস্থা সিরিয়াস ফ্রড ইনভেস্টিগেশন অফিস (এসএফআইও)। সারদা-কাণ্ডে নিজস্ব তদন্ত সেরে তারা কেন্দ্রকে সম্প্রতি যে রিপোর্ট জমা দিয়েছে, তাতেই বলা হয়েছে, রাজ্য পুলিশ তথা বিধাননগর কমিশনারেটের অসহযোগিতার ফলে প্রতি পদে কী ভাবে হোঁচট খেতে হয়েছে তদন্তকারীদের। প্রভাবশালীদের পিঠ বাঁচাতেই যে পুলিশের এ হেন আচরণ, রিপোর্টে তেমন ইঙ্গিত দিতেও কসুর করা হয়নি।

Advertisement

এ প্রসঙ্গেই এসেছে সারদার সেই দৈনন্দিন হিসেব-খাতা (বুক অব অ্যাকাউন্টস)-র কথা, যা কি না কেলেঙ্কারির নেপথ্যের কুশীলবকে চিহ্নিত করার ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ হয়ে উঠতে পারত, অথচ বিধাননগর পুলিশ সেটি এসএফআইও’র হাতে না-দেওয়ায় সুবর্ণ সুযোগ ফস্কে গিয়েছে বলে আক্ষেপ তদন্তকারীদের। বহু কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা-সূত্রের দাবি, সারদার মিডল্যান্ড পার্ক অফিস থেকে কোন কোন নেতার কাছে কবে-কোথায়-কত টাকা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে, তার সব হিসেব খাতাটিতে লেখা ছিল।

প্রসঙ্গত, হিসেবগুলো যাঁরা রাখতেন, তাঁদের দু’জন পরে আদালতে বিচারকের কাছে গোপন জবানবন্দি (১৬৪ ধারায়) দিয়েছেন। তার উপরে সিবিআই-ও ভরসা করছে। ব্যুরোর আশা, সারদা কেলেঙ্কারির পিছনে থাকা ‘বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের’ পর্দা ফাঁস করতে সারদারই দুই অ্যাকাউন্ট্যান্টের এজাহার যথেষ্ট সহায়ক হবে।

Advertisement

তবে সন্দেহ নেই, রোজকার হিসেবের খাতাটির মতো বড় প্রমাণ নাগালের বাইরে থাকায় তদন্ত ঠোক্কর খেয়েছে। শুধু এটাই নয়। সারদা-তদন্তে বিধাননগর পুলিশের কাছ থেকে যে কার্যত কোনও সাহায্যই মেলেনি, কোম্পানি বিষয়ক মন্ত্রকে পেশ করা সাড়ে পাঁচশো পাতার রিপোর্টে এসএফআইও তা নির্দ্বিধায় জানিয়েছে। কী রকম?

এসএফআইও-র দাবি: পুলিশের অসহযোগিতার কারণেই অভিযুক্তদের অফিসে ঢুকে কোনও তথ্য যোগাড় করা সম্ভব হয়নি। কেননা তার আগেই সারদা-কাণ্ডের তদন্তে নেমে বিধাননগর পুলিশ অফিসগুলো সব তালা মেরে বা সিল করে দেয়। পুলিশের কাছে বিভিন্ন নথি চাওয়া হলেও চার্জশিটের প্রতিলিপি ছাড়া কিছু মেলেনি। ‘বারবার চেয়েও নথি ও কম্পিউটার মেলেনি। এমনকী, বিধাননগর পুলিশ যে রিপোর্ট তৈরি করেছিল, পাইনি তার প্রতিলিপিও।’- বলেছে এসএফআইও।

পুলিশের এমন আচরণের ব্যাখ্যা কী হতে পারে?

এসএফআইও-রিপোর্টের ইঙ্গিত, সারদা কেলেঙ্কারিতে জড়িত সমাজের ‘প্রভাবশালী’ অংশকে বাঁচাতেই বিধাননগর কমিশনারেটের পুলিশ তদন্তে সহায়তা করেনি। রিপোর্টে জানানো হয়েছে, পুলিশের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য বা নথি না পাওয়ায় সাকুল্যে সারদার সাতটি সংস্থার ডিরেক্টরদের অভিযুক্ত হিসেবে চিহ্নিত করে ক্ষান্ত দিতে হয়েছে। কারণ, তদন্ত চলাকালীন শুধু তাঁদেরই বিরুদ্ধে কিছু তথ্য এসএফআইও-র হাতে এসেছে। অর্র্থাৎ, কেলেঙ্কারিতে আরও যাঁরা জড়িত বলে প্রাথমিক ভাবে সন্দেহ করা হয়েছিল, তথ্য-প্রমাণের অভাবেই তাঁরা রেহাই পেয়ে গিয়েছেন!

সারদা-তদন্তে নিযুক্ত সিবিআই এবং ইডি-র মুখেও তথ্য-প্রমাণের অভাবের কথা শোনা গিয়েছে বারবার। কেন্দ্রীয় ওই দুই তদন্ত সংস্থার অফিসারদের একাংশের আক্ষেপ, “আমরাও বুঝতে পারছি, কারা টাকা নিয়েছেন। কিন্তু ওঁদের গ্রেফতার করলেই তো হবে না! আদালতের সামনে ঠিকঠাক তথ্য-প্রমাণ পেশ করতে হবে।” অথচ কেন্দ্রীয় তদন্তকারীদের অভিযোগ, পুলিশ হাত গুটিয়ে থাকাতেই সেই সব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-প্রমাণ তাদের কাছে অধরা থেকে গিয়েছে, কখনও আবার পুলিশ আচমকা ‘অতি সক্রিয়’ হয়ে উঠে সম্ভাব্য তথ্য-প্রমাণ সরিয়ে ফেলছে!

যেমন দেখা গিয়েছে সারদার এক ব্যাঙ্ক লকারের ক্ষেত্রে। সল্টলেকের এক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের লকারটি বাজেয়াপ্ত করতে ইডি যখন কোমর বাঁধছে, তখনই বিধাননগর পুলিশ কোর্টের নির্দেশ বার করে লকারের জিনিসপত্র বাজেয়াপ্ত করে সরিয়ে ফেলে।

এ ভাবেই নানা কৌশলে তথ্য-প্রমাণের প্রায় পুরোটাই সরিয়ে ফেলা হয়েছে বলে অভিযোগ। প্রশ্ন উঠেছে, এসএফআইও নির্দিষ্ট ভাবে পুলিশের এমন অসহযোগিতার অভিযোগ তুলে থাকলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসারদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না? বিশেষত যে ‘বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের’ কথা সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল, ওই অফিসারেরা সেই ষড়যন্ত্রের অংশীদার হিসেবে চিহ্নিত হবেন না কেন?

সিবিআই অফিসারেরা বলছেন, এ নিয়ে বেশি নাড়াচাড়া করলে আসল তদন্তের অভিমুখ অন্য দিকে ঘুরতে পারে। উল্লেখ্য, পুলিশি ‘অসহযোগিতা’ নিয়ে সিবিআই-অধিকর্তা রাজ্য পুলিশের ডিজি’র সঙ্গে কথা বলেছিলেন। এ বার এসএফআইও-র মুখেও স্পষ্ট ভাবে অসহযোগিতার নালিশ শোনার পরে পুলিশ কী বলছে?

জানার জন্য এ দিন বিধাননগরের কমিশনার রাজীব কুমারকে ফোন করা হয়। তিনি ফোন ধরেননি। এসএমএসের জবাবও দেননি। রাজ্য পুলিশের তরফে সারদা-তদন্তের পুরোভাগে যিনি ছিলেন, বিধাননগর কমিশনারেটের তদানীন্তন গোয়েন্দা-প্রধান সেই অর্ণব ঘোষের প্রতিক্রিয়াও জানা যায়নি। বর্তমানে নদিয়ার এসপি অর্ণববাবু এ দিন ফোন ধরেননি। এসএমএস করা হলে জবাব আসে, তিনি মিটিঙে ব্যস্ত।

সারদা-কেলেঙ্কারিতে অভিযোগের তির প্রাথমিক ভাবে ছিল মূলত সারদা গোষ্ঠীর চারটি কোম্পানির দিকে— সারদা রিয়েলটি, সারদা ট্যুরস অ্যান্ড ট্র্যাভেলস, সারদা হাউসিং এবং সারদা গার্ডেন রিসর্ট অ্যান্ড হোটেলস। পরে একে একে তালিকায় যোগ হয় সারদা প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশন্স (বাংলা ও ইংরেজি সংবাদপত্র), বেঙ্গল মিডিয়া (শান্তনু ঘোষের থেকে সারদা-কর্ণধার সুদীপ্ত সেন যে বৈদ্যুতিন চ্যানেলটি কিনেছিলেন) এবং গ্লোবাল অটোমোবাইল্স (শান্তনুরই কাছ থেকে সুদীপ্তের কেনা মোটরবাইক তৈরির কারখানা)-এর নাম। এসএফআইও রিপোর্টে জানিয়েছে, পুলিশের সহযোগিতা না-পেয়ে এতগুলো কোম্পানির সমস্ত ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের যাবতীয় লেনদেন তাদের পরীক্ষা করতে হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্কগুলি অবশ্য সাহায্য করেছে। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে কয়েক বছর ধরে সারদা যে কোটি কোটি টাকা তুলেছিল, তার হিসেব পেতে সাহায্য করেছে সফ্টওয়্যার সংস্থা। সারদার শয়ে শয়ে এজেন্টের দেওয়া দৈনিক রিপোর্টও খুঁটিয়ে পড়তে হয়েছে। যাচাই করতে হয়েছে আয়করের বিপুলায়তন নথি। সব মিলিয়ে তথ্য-প্রমাণ জোগাড় করতে এসএফআইও-কে অনেক বেশি কাঠ-খড় পোড়াতে হয়েছে, যাতে সময় নষ্ট হয়েছে বিস্তর। তাতে তদন্তই ব্যাহত হয়েছে। ‘আর এ সমস্তই হয়েছে পুলিশ পাশে না-থাকার কারণে।’— মন্তব্য রিপোর্টে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement