আজ রাত পোহালেই কাল বিশ্ব বঙ্গ সম্মেলন শুরু হবে মিলন মেলায়। তার আগে ভাঙড়ের ঘটনা চিন্তায় ফেলল রাজ্য প্রশাসনকে। সম্মেলনের আগে এই ধরনের ঘটনা বাংলার শিল্প সম্ভাবনায় কী প্রভাব ফেলবে, সেটাই বড় ভাবনা এখন রাজ্য সরকারের।
বাংলায় জমি বিতর্ক নতুন নয়। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের আন্দোলন তো ইতিমধ্যেই ঠাঁই করে নিয়েছে আধুনিক রাজনীতির ইতিহাসে। বাম-ডান দুই শিবিরের বেশির ভাগ নেতাই মনে করেন, ওই দুই জায়গাতেই বাম সরকারের রাজনৈতিক অব্যবস্থা ও অপরিণামদর্শিতার কারণে বাংলার শিল্প সম্ভাবনার যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে। ভাঙড়ের ঘটনা অবশ্য সে রকম নয়। পাওয়ার গ্রিড তৈরির জন্য সেখানে জমি অধিগ্রহণ করা হয়নি। কৃষকদের থেকে সরাসরি কেনা হয়েছিল। প্রকল্পের কাজ শেষও হয়ে এসেছিল। কিন্তু রাজনৈতিক শিবিরের একাংশ, কিছু প্রোমোটার ও সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীর পরস্পর-বিরোধী স্বার্থের কারণেই পরিস্থিতি জটিল হয়েছে বলে প্রশাসন সূত্রে খবর। এই জট কী ভাবে ছাড়ানো যাবে, সে প্রশ্ন আলাদা। কিন্তু শিল্প সম্মেলনের আগে এখন আরও দু’টি মৌলিক প্রশ্ন উঠে আসছে।
l উন্নয়ন প্রকল্প ঘিরেও যদি এমন অশান্তির আশঙ্কা রয়ে যায় তা হলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কী বার্তা যাবে? l ভাঙড়ে গত ৪৮ ঘণ্টায় যে ভাবে রাস্তা অবরোধ, পুলিশকে আক্রমণ, গুলি চলা, ইটবৃষ্টির মতো ঘটনা ঘটেছে তা নন্দীগ্রামের দিনগুলির কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে অনেককে। এটা বর্তমান বাংলার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে কী ধারণার জন্ম দেবে?
শুধু তো ভাঙড় নয়! কাছেই বিষ্ণুপুরের রসপুঞ্জে এক মর্মান্তিক পথ দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে তিন দিন ধরে যা চলেছে, তা-ও যথেষ্ট উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন নবান্নের কর্তারা। পুলিশের বিরুদ্ধে এই রকম জনরোষের প্রকাশকে আর যা-ই হোক শিল্প-সহায়ক বলে মনে করবেন না কেউই। নবান্ন সূত্রে বলা হচ্ছে, ঠিক এই কারণে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও উদ্বিগ্ন। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বুধবার তিনি প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক— দ্বিমুখী কৌশল নেন। সকাল সকাল ভবানী ভবনে গিয়ে পুলিশ-প্রশাসনের কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে নির্দেশ দেন, যে ভাবেই হোক শান্তি ফেরাতে হবে। কারও কোনও অসন্তোষ থাকলে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু সাধারণ মানুষকে উস্কানি দিয়ে স্বার্থান্বেষীরা কোনও এলাকাকে মুক্তাঞ্চল করে রাখবেন, এটা বরদাস্ত করা হবে না।
পাশাপাশি, রাজনৈতিক ভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলার লক্ষ্যে দলের সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি মুকুল রায়ের নেতৃত্বে দলের কিছু নেতাকে ভাঙড়ে পাঠান তৃণমূল নেত্রী। আন্দোলনকারীরা মুকুলকে ভাঙড়ে ঢুকতে বাধা দিলেও দমে যাননি তৃণমূল নেতৃত্ব। এলাকার বিধায়ক রেজ্জাক মোল্লা থেকে শুরু করে পঞ্চায়েত সভাপতি আরাবুল ইসলাম ও আরাবুল-বিরোধী কাইজারকে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়, অশান্তি থামাতে তাঁরাও যেন তৎপর হন।
মুখ্যমন্ত্রীর মনোভাবের কথা এ দিন স্পষ্ট করে দেন, দুই মন্ত্রীও। দলের মহাসচিব তথা শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘রাজ্যের অগ্রগতির কথা মাথায় রেখে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন পরিকল্পিত ভাবে এগোচ্ছেন, উন্নয়ন ও সমাজকল্যাণের নজির রেখে তিল তিল করে রাজ্যের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছেন, তখন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে অশান্তি পাকাতে চাইছে কিছু বহিরাগত। এটা বরদাস্ত করা হবে না।’’ আবাসনমন্ত্রী শোভন চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘কে কী ধরনের রাজনৈতিক চিন্তায় বিশ্বাস করেন, জানি না। এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। কারও কিছু বলার থাকলে আলোচনার টেবিলে এসে বলুন। হিংসা বা অশান্তির কোনও ঘটনাকে বরদাস্ত করা হবে না।’’ রসপুঞ্জের ঘটনা প্রসঙ্গে আবাসনমন্ত্রীর মন্তব্য, ‘‘যে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে তা খুবই মর্মান্তিক। ওই ঘটনার পর স্থানীয় মানুষের দাবি ছিল, কালু শেখকে গ্রেফতার করতে হবে। পুলিশ তা করেছে। কিন্তু সেই দাবিতে পুলিশের ক্যাম্প অফিস জ্বালিয়ে দেব, গাছের গুঁড়ি ফেলে রাস্তা আটকে রাখব, ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি ঢুকতে দেব না— এই সব চলতে পারে না।’’
সূর্যকান্ত মিশ্র, অধীর চৌধুরীদের মতো বিরোধী নেতারা অবশ্য দুষছেন তৃণমূলকেই। তাঁদের অভিযোগ, এই নৈরাজ্যের জন্য শাসক দলই দায়ী। ক্ষমতা ও অর্থের লোভে তাদের নেতা ও গোষ্ঠীগুলি পরস্পরের সঙ্গে সংঘাতে জড়াচ্ছে। কলেজে-কলেজে পর্যন্ত শাসক দলের গোষ্ঠী-লড়াই চরমে পৌঁছেছে।
সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন বা দলীয় রাজনীতির বাইরে এসেও অনেকে বলছেন, ভাঙড়ে রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি ছিল শাসক দলের। এক, এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা বজায়ে রাখতে মুখ্যমন্ত্রী দলের যে নেতাদের উপরে ভরসা করেছিলেন, তাঁদের নিজেদের মধ্যে স্বার্থের লড়াই রয়েছে। দুই, জল কোন দিকে গড়াচ্ছে, তা আঁচ করতে না পারা। প্রাক্তন এক কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রীর মতে, জমি অধিগ্রহণের জন্য মমতা যে নীতি নিয়েছেন, তা ভ্রান্ত নয়। জমি অধিগ্রহণের আদর্শ শর্ত সেটাই। কৃষক ও প্রান্তিক চাষিদের জমির রেকর্ড কম্পিউটারাইজড হয়ে যাওয়ার পরে আগামী দিনে এমন পরিবেশ তৈরি হবে যে, কৃষক যেমন তাঁর জমির বাজারদর সম্পর্কে অবহিত থাকবেন, তেমনই বিনিয়োগকারীও জানবেন, কোন জমির প্রকৃত দাম কত? তখন জমি অধিগ্রহণে সরকার বা মধ্যস্থতাকারীর কোনও ভূমিকা থাকবে না। সে দিক থেকে ভাঙড়ে কিছুটা হলেও সফল হয়েছিলেন মমতা। কৃষকদের কাছ থেকে জমি কিনেই নিয়েছিল পাওয়ার গ্রিড কর্পোরেশন। কিন্তু এখন রাজনৈতিক অব্যবস্থারই মাসুল গুনতে হচ্ছে। তাঁর কথায়, ‘‘আশা করা যায় ভাঙড়ের ঘটনা থেকে শিক্ষা নেবেন মুখ্যমন্ত্রী।’’