বেলপাহাড়ির জামিরডিহার জবা মাহাতোকে মনে আছে? না থাকারই কথা। ধরিয়ে দিলে দিব্যি মনে পড়বে। জবা সেই মেয়ে যিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে মাওবাদী স্কোয়াডে চলে গিয়েছিলেন। জঙ্গলমহলে মাও-আন্দোলন অস্তমিত। কিন্তু জামিরডিহার জবা-মাওবাদী এখনও নিরুদ্দেশ।
পঞ্চায়েত উত্তর জঙ্গলমহলে এসে জবার বাড়ি যাওয়া গেল। তাঁর মা লুলকি এখনও থাকেন সেখানে। জবাব বাড়ির দেওয়ালে লেখা, বিশ্বনাথ মাহাতো। জাতি-কুড়মি, ধর্ম-সারনা। বিশ্বনাথ জবার ভাই। লুলকিকে প্রশ্ন করি, জবা থাকলেও কি তাই লিখতেন? তাঁর জবাব,‘‘ একই লিখতাম। জবা মাহাতো, জাতি-কুড়মি, ধর্ম-সারনা।’’ বুঝতে অসুবিধা হয় না, জামিরডিহার দেওয়াল লিখন বলছে, মাওবাদী জবা এখন মাহাতো হয়েছেন।
শুধু জামিরডিহা নয়, ছুরিমার, বকডোবা, ময়ূরঝর্ণা, কাঁকড়াঝোর, আমলাশোল, ওদোলচুয়া সর্বত্র এখন জাতিসত্ত্বার প্রকাশ নজরকাড়া। মাহাতো নিজেকে সদর্পে কুড়মি বললে, জনজাতি-মূলবাসীরাও জাতি পরিচয়ে পিছপা নন। এমনকী বেলপাহাড়িতে তৃণমূলকে ধাক্কা দিয়েছে যে আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চ, তাও গড়ে উঠেছে সাঁওতাল, মুণ্ডা, ভূমিজদের নিয়ে। অবাক করার কারণ আরও রয়েছে। যে দু’টি গ্রাম পঞ্চায়েত আদিবাসী মঞ্চ দখল করেছে, সেখানে কোথাও কোনও ভোটের প্রচার বা দেওয়াল লিখন নেই।
তা হলে জয় এল কী করে? বাঁশপাহাড়ির সুধাময় মুর্মুর কথায়, ‘‘সমাজ থেকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল তৃণমূলকে হারাতে হবে। আমাদের তো অন্য প্রচার লাগবেনা।’’ সমাজের এই সিদ্ধান্ত কতটা গভীরে ছড়ানো তার প্রমাণ ভুলাভেদা গ্রাম পঞ্চায়েত। সেখানে লড়াই বিজেপি বনাম আদিবাসী মঞ্চের। তৃণমূল তৃতীয় স্থানে।
আরও পড়ুন: বাড়ল ব্যবধান, জয় তৃণমূলের
সুধাময় জানাচ্ছিলেন, শাসক দল অনেক চুরি-জোচ্চুরি করেছে। পাশাপাশি মূলবাসীদের অবহেলা করে মাহাতোদের নিয়ে মাতামাতি করেছে। তাই জনজাতিদের নিজেদের অধিকাররক্ষার স্বার্থে একজোট হতে হয়েছে। নন্দ মুণ্ডাও মনে করেন, ‘‘সরকার মাহালি, মাহাতোদের বেশি মাথায় তুলছে। তাই বুঝে নেওয়ার সময় এসেছে।’’
শুধু বাঁশপাহাড়ি নয় ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়া ও বাঁকুড়ায় জঙ্গলমহলের বাসিন্দাদের পরিচয় ছিল মূলত রাজনৈতিক। কোন গ্রামে সিপিএমের, কোন গ্রামের কোন পাড়া কংগ্রেসের তা বলে দিতে পারতেন গ্রামের মুরুব্বিরা। সেই অবস্থা ক্রমেই বদলে জঙ্গলমহল এখন সাঁওতাল, মুণ্ডা, ভূমিজ, মাহাতোতে ভাগ হয়ে গিয়েছে। নিজেদের জাতির পরিচয় এতটাই তীব্র হয়েছে যে মাহাতোরা বাড়ির দেওয়ালে নাম-জাতি-ধর্ম সদর্পে লিখে রাখছেন। আদিবাসীরা আবার বাড়িতে তুলেছেন নিজস্ব পতাকা। সাঁওতাল, মুণ্ডা বা ভূমিজদেরও আবার সমাজের পৃথক পতাকা। জঙ্গলের অন্দরে পতাকা আর দেওয়াল লিখনেই তাই প্রকট জাতি পরিচয়।
যার প্রভাব পড়েছে ভোটেও। কারণ, তিন জেলার জঙ্গলমহলে কুড়মিদের জনসংখ্যা প্রায় ৩৫%। সাঁওতাল ২১%। অন্যান্য জনজাতিরাও প্রায় ১০%। চাষের জমির মালিকানা সিংহভাগই কুড়মি বা মাহাতোদের। এমনই এক আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে জনজাতি-কুড়মি বিভেদ বাড়িয়েছে রাজ্য সরকার মাহাতোদের জনজাতি হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি মেনে নেওয়ায়। তবে রাজ্যের কালচারাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট (সিআরআই)- মাহাতোদের জনজাতি হিসাবে ঘোষণা করার যে দস্তাবেজ কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পাঠিয়েছিল, তা এখনও গ্রহণযোগ্য বলে মান্যতা পায়নি। এমন প্রেক্ষাপটে কুড়মি সমাজ ‘জনজাতি’ হতে আন্দোলন করছে। আর জনজাতি সমাজ কুড়মিদের ঠেকাতে কৌশলে নেমেছে। রাজ্য সরকার তবে ‘জনজাতি’ হতে রাজ্য সাহায্য করছে এই ভাবনা থেকে মাহাতো-মহল্লায় তৃণমূলের গ্রহণযোগ্যতা পঞ্চায়েত ভোটেও স্পষ্ট হয়েছে।
আদিবাসী কুড়মি সমাজের রাজ্য সম্পাদক রাজেশ মাহাতোর কথায়, ‘‘১৯৩১ সাল পর্যন্ত আমরা তফসিলি জনজাতি ছিলাম। তারপর তালিকা থেকে বের করা হয় কুড়মিদের। সেই অধিকার ফেরত পেতে হবে। আন্দোলন চলছে। অথচ মাহাতো সমাজের বিধায়ক, সাংসদ, মন্ত্রীরা আমাদের পাশে দাঁড়াননি। ফল ভুগতে হয়েছে পঞ্চায়েতে।’’ ভারত জাকাত মাঝি পারগনার দুই মেদিনীপুরের প্রধান রবিন টু়ডু আবার মনে করেন, ‘‘আমরা প্রকৃতি পুজো করি। কুড়মিরা তো নিজেদের ক্ষত্রিয় বলে দাবি করে। হিন্দুরীতি মেনে পুজো করে। কীভাবে জনজাতির মর্যাদা পাবে?’ এ সব চিন্তাভাবনা করেই কি জনজাতি সমাজ পঞ্চায়েতে ভোট দিয়েছে? রবিনবাবুর ব্যাখ্যা, ‘‘শুধু তাই নয়।, জনজাতিরা তৃণমূল কংগ্রেস বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি রুষ্ট নয়। কিন্তু নীচুতলার নেতা-কর্মীরা এত চুরি করেছেন যে জনজাতিরা বঞ্চিত হয়েছে। ফলে সেই সুবিধা বিজেপি পেয়ে গিয়েছে।’’
জঙ্গলমহল জুড়ে জাতিসত্তার জাগরণে রাজনীতির কারবারিরাও রুটি সেঁকতে ব্যস্ত। শাল-মহুলের বনের আওয়াজ, শাসক দলও নাকি কোনও এক বন্দি নেতাকে এগিয়ে দিতে চায় ভোটের ফসল তুলতে। বিভাজিত এই সমাজে সেই ‘ছাতা’ কতটা কাজে দেবে? সংশয় থাকছেই।
(শেষ)