নানুরের খালেক শেখ। নিজস্ব চিত্র
এক সময় এলাকায় তিনি ছিলেন শাসকদলের আন্দোলনের অন্যতম মুখ। এ বার মেলেনি ভোটে লড়ার টিকিট। এলাকায় চর্চা, জনতার সামনে জবাবদিহি করতে করতে ক্লান্ত আব্দুল খালেক শেখ-ই এ বার তাই মুখ লুকিয়েছেন।
স্থানীয় সূত্রের খবর, বছর ষাটের আব্দুল খালেকের বাড়ি নানুরের নওয়ানগর-কড্ডা পঞ্চায়েতের পুরন্দরপুর গ্রামে। জন্মলগ্ন থেকেই তৃণমূলে রয়েছেন। ২০০০ সালে ওই পঞ্চায়েতের সুচপুরে ১১ জন তৃণমূল সমর্থক খেতমজুর খুন হন। অভিযোগ উঠেছিল সিপিএমের দিকে। রাজ্য রাজনীতি তোলপাড় করা ওই হত্যাকাণ্ডকে সামনে রেখে নানুর ও সংলগ্ন এলাকায় সহানুভূতির হাওয়া পালে লাগে তৃণমূলের। সেখানে পায়ের নীচে মাটি খুঁজে পায় বর্তমান শাসকদল। অনেকের দাবি, সেই হত্যাকাণ্ডের অন্যতম সাক্ষী ছিলেন আব্দুল খালেক। দলীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, আদালতে সাক্ষ্য না দিতে তাঁকে মোটা টাকার প্রলোভনও দেওয়া হয়েছিল। মিলেছিল প্রাণনাশের হুমকিও। প্রাণ বাঁচাতে ৩-৪ বছর গ্রামছাড়া হয়ে বোলপুর ও কলকাতার দলীয় কার্যালয়ে দিন কাটাতে হয় তাঁকে। তাঁর জন্য এক দেহরক্ষী মোতায়েন করেছিল তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার।
তৃণমূল সূত্রেরই খবর, এর পরেও ওই মামলায় সাক্ষ্য দেন তিনি। ৪৪ জন সিপিএম নেতাকর্মীর যাবজ্জীবন সাজা হয়। তাদের কয়েক জন পরে মুক্তি পেলেও, বেশির ভাগ এখনও সাজা খাটছেন। আদালতের রায়ও নানুরে তৃণমূলকে শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করিয়ে দেয়। বাসাপাড়ায় শহিদ দিবসে এসে দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পর্যন্ত খালেককে ‘আন্দোলনের মুখ’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। তাঁর ছোটছেলেকে রেলে চতুর্থ শ্রেণির কর্মীর চাকরিও করিয়ে দেন তৎকালীন রেলমন্ত্রী মমতা।
দলের নেতাদের একাংশের বক্তব্য, সেই খালেকই এখন দলে কার্যত ব্রাত্য হয়ে পড়েছেন। ২০১৩ সালের নির্বাচনে তিনি ওই পঞ্চায়েত এলাকা থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে নানুর পঞ্চায়েত সমিতির বিদ্যুৎ কর্মাধ্যক্ষ মনোনীত হন। কিন্তু, এ বার পঞ্চায়েত সমিতি দূর, গ্রাম পঞ্চায়েতের কোন আসনেও টিকিট পাননি তিনি। স্থানীয় তিনটি পঞ্চায়েত সমিতির আসনে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বিতার কোনও আইনি সমস্যা না থাকলেও নানুর পঞ্চায়েত এলাকার এক ব্যবসায়ী তথা আগে সিপিএমের টিকিটে পঞ্চায়েত সমিতির ভোটে লড়া এক ব্যক্তি এবং দলের পঞ্চায়েত প্রধানকে টিকিট দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, অভিযোগ তাঁর আপত্তি অগ্রাহ্য করে সুচপূর হত্যাকাণ্ডে সাজা খাটছে এমন এক ব্যক্তির পুত্রবধূকেও পঞ্চায়েতে প্রার্থী করেছে তৃণমূল। ২০১০ সাল থেকে দেহরক্ষীও নেই তাঁর। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরও তা আর বহাল করা হয়নি। আদালতে সাক্ষী দেওয়ার জেরে যাবজ্জীবন সাজা পাওয়া লোকেদের পরিজনেরা এখনও তাঁর উপরে ক্ষুব্ধ বলে খালেকের আশঙ্কা।
ভোট ময়দানে খালেকের না থাকা নিয়ে দলের অন্দরমহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ছড়িয়েছে। দলের ব্লক কমিটির সদস্য তথা পঞ্চায়েত সমিতির এক বিদায়ী কর্মাধ্যক্ষ জানান, ‘‘আমার সামনেই তৎকালীন সিপিএম নেতারা খালেককে মোটা টাকা নিয়ে সাক্ষী না দেওয়ার জন্য রফা করতে চেয়েছিলেন। খালেক সেই প্রলোভনে পা দেননি। আমাদের দুর্ভাগ্য, এখন অন্য দল থেকে আসা ভুইফোঁড় নেতারা দেহরক্ষী নিয়ে দলে কর্তৃত্ব করছেন। খালেকের মতো লোকেদের দলে কোনও জায়গা নেই।’’
খালেকের অবশ্য এ নিয়ে কোনও অনুযোগ নেই। তিনি বলেন, ‘‘অঞ্চল কমিটির সভাপতি হিসেবে আমি শুধু সাজাপ্রাপ্তের পরিবারের কোনও সদস্যকে মনোনয়ন দেওয়া নিয়ে আপত্তি তুলেছিলাম। দল ভাল বুঝছে বলেই হয়তো মনোনয়ন দিয়েছে। আমাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি কেন তা-ও অনেকে জিজ্ঞাসা করছেন। তাঁদেরও একই কথা বলেছি।’’
মুখে যাই বলুন না কেন, তাঁর বক্তব্যে চাপা থাকেনি অভিমান। দলের ব্লক সভাপতি সুব্রত ভট্টাচার্য অবশ্য বলেছেন, ‘‘দলীয় স্তরে আলোচনা করেই প্রার্থী বাছাই করা হয়েছে। যাঁদের প্রার্থী করা হয়েছে তাঁরা সবাই আমাদের কর্মী। এর বেশি কিছু বলব না।’’